২০১৯-২০ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বাজেটও শুধু সংখ্যা নয়। তার অভিঘাত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঠিক কতটা গভীর। —ফাইিল চিত্র
আর কয়েক ঘণ্টা পরেই পরেই সাধারণ বাজেট। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন দাবি করেছেন, গত ১০০ বছরে দেশে এমন সংস্কার কেউ প্রত্যক্ষ করেননি। অন্য দিকে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, বৈপ্লবিক সংস্কার নয়, সময় এসেছে আগে অর্থনীতির হাল ধরে এই কঠিন সময় পার করার।
গত প্রায় ৯ মাস ধরে বাজার ডামাডোলে রয়েছে। এর মধ্যে একটা বড় সময়ই ঝাঁপ বন্ধ ছিল বাজারের। মানুষজন চাকরি হারিয়েছেন, আয় কমেছে, পাশাপাশি করোনা আক্রান্তদের বড় খরচের ধাক্কাও সামলাতে হয়েছে। ২০১৯-২০ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, অর্থনীতি শুধু একটা সংখ্যা নয়। বাজেটও শুধু সংখ্যা নয়। এর অভিঘাত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঠিক কতটা গভীর।
মাথায় রাখতে হবে, ২০২১-২২ এ অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ১১ শতাংশে ফেরাটা কিন্তু দেখতে হবে ২০১৮-১৯ এর আলোতে। যদিও এটা ঠিক যে, আইএমএফ-সহ বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশের আর্থিক সমীক্ষাও দাবি করেছে, এই বৃদ্ধি উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে সর্বাধিক। শুধু উন্নয়নশীল দেশ কেন, অনেক উন্নত দেশের চেয়েও বেশি। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, ভারতের গড় সঙ্কোচন অতিমারি কালে কিন্তু ৭.৫ শতাংশের উপরে। এখনও পর্যন্ত এগুলি সবই সমীক্ষা এবং অনুমান। আসল ক্ষতির পরিমাণ আমাদের হাতে আসতে আরও সময় লাগবে। কিন্তু যদি ২০১৮-১৯ এর পাশে এই ঘুরে দাঁড়ানোকে তুলনা করে ধরে নেওয়া যায় যে, ১৯-২০ আমাদের জীবনে নেই, তা হলে আসল বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে মাত্র ২.৬ শতাংশের আশপাশে। সেটা কিন্তু অন্য দেশের তুলনায় বেশ কম। এই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষের হাতে যদি আরও বেশি টাকা তুলে না দেওয়া যায়, অর্থনীতিতে বাজারে খরচের প্রবণতা না ফেরানো যায়, তা হলে বৃদ্ধির হার বাড়ানো যাবে না। আর সেটা করতে গেলে সরকারের খরচ বাড়াতে হবে। কিন্তু যখন কোষাগার প্রায় তলানিতে বলে মনে করা হচ্ছে, তখন সরকারের কাছে একমাত্র উপায় হচ্ছে, আরও বেশি ধার করা। কিন্তু সেই রাস্তাও খুব পিচ্ছিল। কারণ, আজ ধার করলে কাল শোধ করতে হবে।
আর্থিক সমীক্ষা বলছে, ধারের উপর যে সুদ দেওয়া হয়, তা ধারের থেকে বেশি হলে সরকার এই ধার এবং তার অভিঘাত সামলাতে পারবে না। কিন্তু পাশাপাশি যদি দেখা যায়, অর্থনীতিকে বড় মাপের বৃদ্ধির পথে ফেরাতে বাজারে খরচ বাড়ানোটাই এই মুহূর্তে বড় প্রয়োজন, তা হলে ব্যক্তিগত আয়করের হার কমাতে হবে। অনেকেরই আশা, এই প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে সরকার আয়করের হারে বড় মাপের ছাড় দিতে পারে। কিন্তু এই আশা বাস্তব হওয়ার পথে বড় বাধা হচ্ছে রাজকোষের আয় বাড়ানো। অনেকেই বলছেন, এই রাস্তায় হাঁটলে বৃদ্ধি বাড়বে। কর হার কমলেও বৃদ্ধি ঊর্ধ্বগতিতে থাকায় মানুষের আয়ও বাড়বে এবং সেই কারণে আয়কর বাবদ রোজগার কমবে সরকারের। কিন্তু সীতারামন এই পথে হাঁটতে পারবেন কি না, বা হাঁটবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
অতিমারি দেখিয়েছে, শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমাদের দেশে কতটা প্রয়োজন। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে চিকিৎসার সুযোগ নেওয়া দু’টো কারণে বড় চ্যালেঞ্জ নাগরিকদের কাছে। বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা ক্রমাগত সাধারণ মানুষের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। অতিমারির সময় বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাকেও যাতে কোভিডের চিকিৎসার খরচ যাতে সাধারণের আয়ত্তের মধ্যে থাকে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের গণস্বাস্থ্য ব্য়বস্থায় খরচ বাড়ানো সত্যি প্রয়োজন। গত বছর ৬৪ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় খরচ হিসেবে বরাদ্দ করা হয়েছিল। এ বছর টিকাকরণে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার আশেপাশে খরচ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে গত বছরের খরচ যদি একই রাখা হয়, তা হলেও টিকাকরণ খাতে যে খরচ হবে, তাতে প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
একই ভাবে মাথায় রাখতে হবে শিক্ষা খাতে খরচের কথাও। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার একটা বড় প্রয়োজনীয়তা অতিমারি দেখিয়ে দিয়েছে। এই ভাবে এগিয়ে গেলে প্রতিটি সামাজিক খাতেই সরকারের ব্য়য় বরাদ্দ বাড়ানোর একটা বড় চাপ কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। এরই পাশাপাশি রয়েছে মাঝারি, ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র সংস্থাগুলিকে সহজে ব্য়বসা করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। কারণ এই ক্ষেত্রেই ভারতে কর্মসংস্থানের একটা বড় অংশ তৈরি হয়। এই ক্ষেত্রগুলি যদি সহজে ঘুরে দাঁড়ায়, তা হলে কর্মসংস্থান বেড়ে বাজারে চাহিদা বাড়ার রাস্তাটাও সহজ হয়ে উঠবে। কিন্তু কী ভাবে এই চাপ অর্থমন্ত্রী সামলাবেন, সেটা দেখার জন্যই সবাই উন্মুখ হয়ে রয়েছেন।
একই সঙ্গে রয়েছে আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পেট্রোল, ডিজেল ও গ্যাসের দাম ঊর্ধ্বমুখী। সাধারণ মানুষের কাছে তাই গণযোগাযোগ ব্যবস্থাও অনেক বেশি খরচ সাপেক্ষ হয়ে উঠছে। এক দিকে তাঁদের আয় কমছে, অনের দিকে রান্নাঘরের আঁচের খরচও বাড়়ছে। একটি হিসেব বলছে, পেট্রোলের দাম ৮৭টাকা প্রতি লিটার হলে প্রায় ৫২ টাকার মতো শুধু কর বাবদ যাচ্ছে মানুষের পকেট থেকে। ডিজেলের ক্ষেত্রেও অঙ্কটা কাছাকাছি। অর্থাৎ সরকার রাজকোষ ধরে রাখতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। যখন কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হচ্ছে এবং এমন সময়েও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ শুধু করের কারণেই বাড়ছে, তাতে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কোষাগার ঠিক রাখাটাই সরকারের কাছে অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই অতিমারির সময় অতি বড়লোকদের আয় বেড়েছে এবং সাধারণ মানুষের আয় সঙ্কুচিত হয়েছে। অর্থাৎ বাজারে যে বৈষম্য ছিল, তা আরও বেশি বেড়েছে। এটা নিয়েও অর্থনীতিবিদরা চিন্তিত। চিন্তিত এই কারণে যে, সরকারি কর ব্যবস্থা যতটা না আয় পুনর্বণ্টনের পথে হাঁটছে, তার থেকেও বেশি জোর রয়েছে কোষাগার সামলানোয়। রাজকোষ সামলানো সরকারের কাজ। একই সঙ্গে এটাও সরকারের দায় যে, এমন ভাবে হাঁটতে হবে, যাতে বৈষম্য না বাড়ে। কারণ বৈষম্য বাড়লে উন্নয়ন ব্যাহত হয়। তাই কর কমানোর আশা ঠিক কতটা পূর্ণ হবে এই বাজেটে এবং মানুষের হাতে খরচের জন্য টাকা কী ভাবে যোগাবেন অর্থমন্ত্রী, তা বোঝা যাবে সোমবারের বাজেটেই।