কালিকা বঙ্গদেশে চ। কালী হলেন বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী। সাধক রামপ্রসাদ লিখেছিলেন, “কে জানে কালী কেমন?” সাধক ছাড়া কেই-বা বলবে এই গুহ্য কথা! কালী হলেন জগদকারণ প্রকৃতি। সাংখ্য ও তন্ত্র দর্শনের কেন্দ্রে আছেন এই প্রকৃতি: অব্যক্ত, আদ্যা, নিত্যা, অদ্বয়। তিনি কে? স্বয়ং না বোঝালে তা কি বুঝিতে পারি। একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা, শ্রী শ্রী চণ্ডীতে দেবী স্বয়ং বলেন: “এই জগতে এক মাত্র আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কে আছে!”
কোথা থেকে এলেন করালবদনী এই দেবী?
এ বিষয়ে একাধিক সূত্র রয়েছে। যেমন, তন্ত্র অনুসারে কালী দশ মহাবিদ্যার প্রথম দেবী। মহানির্বাণতন্ত্র বলছে.....
“তব রূপং মহাকালো জগৎসংহারকারকঃ।
মহাসংহার সময়ে কালঃ সর্বং গ্রসিষ্যতি।।
কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্তিতঃ।
মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরা।।
কালসংগ্রসনাৎ কালী সর্বেষামাদিরূপিণী।”
অর্থাৎ “হে কালী, জগৎ সংহারক মহাকাল তোমারই একটি রূপ। এই মহাকাল, মহাপ্রলয়ের সময় সমুদায় জগৎ গ্রাস করবেন। সর্বজনকে কলন করেন বলেই তিনি মহাকাল, সেই মহাকালকেও তুমি গ্রাস করো, তাই তুমি পরাৎপরা আদ্যাকালী।”
যোগিনী তন্ত্রে শিবের উক্তি,
“মহামহা ব্রহ্মবিদ্যা বিদ্যেয়ং কালিকা মতা
যামাসাদ্য চ নির্বাণ মুক্তিমেতি নরাধম।
অস্যা উপাসকাশ্চৈব ব্রহ্ম -বিষ্ণু-শিবাদয়ঃ
রহস্যং কথ্যতে দেবি সর্বলোকা উপাসকাঃ।।”
অর্থাৎ,“দেবী কালিকাই মহা-মহা ব্রহ্মবিদ্যা। নিকৃষ্টতম পাপীও তাঁর শরণ নিলে নির্বাণ মুক্তি পর্যন্ত লাভ করতে পারে। সৃষ্টি-পালন-লয়ের কর্তা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শঙ্করও এই দেবীর উপাসক। তাঁরই উপাসনা-রহস্য ব্যক্ত হচ্ছে।” এই তন্ত্রেই আরো আছে- “কালী চ জগতাং মাতা সর্বশাস্ত্রেষু নিশ্চিতা।”- অর্থাৎ কালী যে জগতের মাতা সর্বশাস্ত্রেই তা নিশ্চিত করে বলা হয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, “কালী” শব্দটি অথর্ববেদে প্রথম পাওয়া যায়। ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত “দেবীমাহাত্ম্যে” স্বতন্ত্র দেবী হিসেবে কালীর উল্লেখ মেলে। অন্যদিকে দেবীপুরাণ অনুসারে, দেবী দুর্গারই অন্যতম রূপ কালী। অসুরকুলের সঙ্গে দুর্গার দ্বৈরথ শুরু হয়েছে। ঘোরতর যুদ্ধ চলছে। চণ্ড ও মুণ্ড দেবী দুর্গাকে আক্রমণ করেছে। সেই যুদ্ধকালেই ক্রোধান্ধ দেবীর তৃতীয় নেত্র থেকে কালীর উৎপত্তি। কালীর চেহারা গাঢ় নীল, কোটর-নিমজ্জিত চক্ষু এবং পরনে বাঘের চামড়া, গলায় মুণ্ডমালা। তিনিই চণ্ড-মুণ্ডকে বধ করে দুর্গার কাছে এসে তাঁকে দুই অসুরের মাথা উপহার দেন। ওই একই যুদ্ধে অসুর রক্তবীজ অপরাজিত থাকে কারণ তার রক্তের প্রতিটি ফোঁটা মাটিতে পড়া মাত্রই তা থেকে ফের নতুন রক্তবীজ জন্মায়। অগণিত রক্তবীজ হাজির হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। কালী তখন দুর্গার অস্ত্রে বধ হওয়া রক্তবীজের রক্তবিন্দু মাটিতে পৌঁছনোর আগেই তা তাঁর জিহ্বা দিয়ে লেহন করেন। পুরাণের এই কালীই পরবর্তীতে ফিরে ফিরে এসেছেন। তিনি উৎস, তিনি সমাপ্তি, তিনি ছাড়া আর কিছু নেই।
“কলৌ কালী কলৌ কালী নান্যদেবো কলৌযুগে।” এই কালী কেবল শাক্তদের দেবী নন, তিনি জগজ্জননী। শৈবদের পরম উপাস্য, কারণ মহাকাল ও মহাকালী অভিন্ন। কালী ও দুর্গা অভিন্ন। দুর্গাপূজার কেন্দ্রে যে সন্ধিপুজো, সেই মহাষ্টমী এবং মহানবমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপুজোর বলি গ্রহণ করেন স্বয়ং চামুণ্ডা কালী। কালীর দর্শন ও তত্ত্ব তো অসীম। মহাপ্রলয়ের কালশক্তি মহাকালীর ভিতরেই নিঃশেষ লীন হয়ে যায়।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy