এ কাহিনি বহু যুগ আগের। নদিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র রাঘবরাম মজুমদার গঙ্গার পাশে সুবিশাল এক মন্দির গড়ে তাতে গণেশ দেবকে স্থাপনা করেন। সেটা ১৬৬৯ খৃষ্টাব্দ। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পরপরই তাঁর দেহাবসান ঘটে। সে ভাবেই চলছিল সব। এর একশো বছর পরে আনুমানিক ১৭৬০ সাল নাগাদ গঙ্গায় ভীষণ বন্যা হয় এবং পাড়ের ভাঙন শুরু হয়
তমোঘ্ন নস্কর
কলকাতাশেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৪ ১৩:০৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৩
সর্বনাশ! উপায় কী! এমনি করে দেবতার অঙ্গহানি! শেষে বিধান দিলেন সিদ্ধান্তবাগীশরা। পুত্রের মূর্তিকে মায়ের মূর্তিতে রূপ দাও। আগে ওঁরাই এই মূর্তিকে ১২ বছর সবার অলক্ষে মাটির গভীরে প্রোথিত রাখতে বলেছিলেন। মাটি থেকে তুলতে গিয়েই এমন বিপত্তি! আবার ওঁরাই এমন বিধান দিচ্ছেন! দ্বন্দ্বে পড়লেন রাজা। তবুও শেষমেশ সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে রাজা গিরিশচন্দ্র মনস্থির করলেন। ভিনদেশ থেকে এলেন অজ্ঞাতনামা এক শিল্পী। বহু শতাব্দী প্রাচীন গণেশ ঠাকুরের মূর্তিতে গড়ে উঠল মায়ের মূর্তি! মা পরিচিতা হলেন ‘ভবতারিণী’ নামে!
০২১৩
এ কাহিনি বহু যুগ আগের। নদিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র রাঘবরাম মজুমদার গঙ্গার পাশে সুবিশাল এক মন্দির গড়ে তাতে গণেশ দেবকে স্থাপনা করেন। সেটা ১৬৬৯ খৃষ্টাব্দ। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পরপরই তাঁর দেহাবসান ঘটে। সে ভাবেই চলছিল সব। এর একশো বছর পরে আনুমানিক ১৭৬০ সাল নাগাদ গঙ্গায় ভীষণ বন্যা হয় এবং পাড়ের ভাঙন শুরু হয়।
০৩১৩
সে সময়ে নদিয়ার সিংহাসনে দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। তিনি মূর্তিগুলি সরিয়ে আনেন। কিন্তু মূর্তির অবস্থান পরিবর্তনের জন্য এবং বহু মানুষের স্পর্শে আসার কারণে সিদ্ধান্তবাগীশেরা সেই মূর্তিকে তৎক্ষণাৎ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধা দেন এবং বারো বৎসর মাটিতে পুঁতে রাখার সিদ্ধান্ত জানান।
০৪১৩
দিন এগোয় আরও। সিংহাসনে তখন কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্র। তিনি মূর্তি তোলার আদেশ দেন। উত্তোলনের সময়ে গণেশ ঠাকুরের শুঁড়টি যায় ভেঙে। এমত অবস্থায় অনেক সিদ্ধান্তের পরে বিধান দেওয়া হয় যে, গণেশ ঠাকুরের মূর্তিটিকে মা ভবতারিণীর মূর্তিতে পরিবর্তন করা হলে সব শুদ্ধি হবে। এবং সেই মতো গড়ে ওঠে মা ভবতারিণীর মূর্তি।
০৫১৩
সেই কারণে তথাকথিত কালী মূর্তি থেকে এই মূর্তিটি সম্পূর্ণ রূপে আলাদা। এখানে মা জোড়াসনে উপবিষ্টা। কান ও জিভের কাছটা লক্ষ্য করলে আগের গণেশ মূর্তির আভাস পাওয়া যায়। কালী মূর্তির নীচে শায়িত শিবও সাধারণের চেয়ে একটু আলাদা। দালান-সহ মন্দিরটি সমতল ছাদের উপর পঙ্খ-অঙ্কিত শিখরযুক্ত চারচালা মন্দির।
০৬১৩
মহারাজা রাঘব রাম কেবলমাত্র গণেশমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে পাশে মন্দির করার কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে গণেশ মূর্তি স্থাপনার পরেই তিনি মারা যান। তাই সেই শিব মন্দির সম্পূর্ণ হয়নি। সেই প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ করেন তাঁর পুত্র রুদ্রদেব।
০৭১৩
তিনি গৌরীপট্ট বিশাল শিবলিঙ্গ স্থাপনা করেন, নাম দেন রাঘবেশ্বর শিব। ১৭৬০ সালের ভীষণ বন্যার পরে গণেশ মূর্তিটি উদ্ধার করা গেলেও শিবমূর্তি-সহ সম্পূর্ণ মন্দিরটি নিমজ্জিত ছিল। ৬৫ বছর পরে রাজা গিরিশচন্দ্র যখন মা ভবতারিণীর প্রতিস্থাপনা করেন, তখন সেই শিবলিঙ্গটিকেও তুলে নিয়ে এসে আটকোনা ছাদবিশিষ্ট একটি শিবমন্দির গড়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। বাংলায় এমন আটকোনা ছাদ বিশিষ্ট শিবমন্দির এই একটিই। সেই থেকে(১৮২৫ সাল) মা ভবতারিণীর পাশে তিনি ‘ভবতারণ শিব’ নামে পরিচিত।
০৮১৩
১৯১১ থেকে ১৯২৮-এর মধ্যে তদানীন্তন নদিয়ারাজ ক্ষৌণিশ চন্দ্রের আমলে মন্দিরটি সংস্কার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ২০১৯ সালে মন্দিরটিকে নবদ্বীপের হেরিটেজ মন্দির হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
০৯১৩
এই দুই মন্দিরের মাঝে রয়েছেন নবদ্বীপের কিংবদন্তি পোড়ামা। বলা হয়, পোড়ামা এই দু’জনকে দু’দিক দিয়ে ধরে রেখেছেন। সে বহু যুগের কথা। রামভদ্র সিদ্ধান্তবাগীশ মা দক্ষিণাকালীর সাধক ছিলেন। গোপাল মন্ত্রে সিদ্ধ অন্য এক পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁর শাস্ত্রীয় বিচার হয়।
১০১৩
পরাজিত ব্যক্তি বিজয়ীর মন্ত্রশিষ্য হবেন, এমন প্রতিজ্ঞায় বিচার ও তর্ক শুরু হয়। সিদ্ধান্তবাগীশ পরাজিত হন। অতএব, এ বার তাঁকে প্রতিজ্ঞা রাখতে হবে। নিজ ইষ্টমন্ত্র ত্যাগ করতে উদ্যত হন তিনি। আচমকা ভয়ানক আগুন ধরে যায় তাঁর ভদ্রাসনে। বাড়ি এবং মন্দির সবই পুড়ে যেতে থাকে। বাড়ি যায় যাক, কিন্তু মন্দির! সেখানে যে আরাধ্যা রয়েছেন!
১১১৩
মন্দিরের দিকে ছুটে যান তিনি। আর সেখানেই দেবীর করালমূর্তি তাঁর গোচর হয়। কী আশ্চর্য, দেবীর কোলে গোপাল উপবিষ্ট!
১২১৩
দেবীর ঘটের মন্ত্রশোধিত জল ছড়িয়ে দিতেই আগুন নিভে যায়। রয়ে যান রামভদ্র এবং মন্দিরের অবশিষ্ট দু'টি মাত্র ইট। সেখানেই ঘটস্থাপন করে তিনি মায়ের পুজো করতেন। এর বহু বছর পরে বাসুদেব সার্বভৌম সেখানেই মা দক্ষিণা কালীর ঘটস্থাপন করে পুজো করতেন।
১৩১৩
সেই ইট দু’খানা আজও পোড়া-মার আধার হয়ে রয়েছে। এবং তার উপরেই ঘটস্থাপন করে পুজো হয়। আজও বটগাছের নীচেই রয়ে গিয়েছেন মা। দগ্ধ আধার থেকে পোড়া মা, দুই পাশে ভবতারিণী মা আর ভবতারণ শিব। পরম বৈষ্ণব ক্ষেত্রে মা আজও পুজো পান মহাসমাদরে। এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।