একটি ভয়ঙ্কর অপরাধের অকুস্থল থেকে এক মানবিক সম্পর্কের সূচনা।
ব্রুকলিনে দোতলার ফ্ল্যাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ১০ জনের দেহ। এদের মধ্যে ৮ জনই শিশু। কেউ সোফায় বসে, কেউ চেয়ারে। এক মহিলার হাতে তখনও পুডিংয়ের ক্যান আর চামচ। কেউ এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে সকলকে শেষ করে দিয়েছে। এক জনই শুধু প্রাণে বেঁচে গিয়েছে, ১৪ মাসের একটি মেয়ে ক্রিস্টিনা রিভিয়েরা। মায়ের রক্তাক্ত শরীরের পাশে দিব্যি হামাগুড়ি দিচ্ছিল সে। খবর পেয়ে প্রথম যে পুলিশ অফিসার ঘটনাস্থলে আসেন, তিনি এক মহিলা। নাম জোয়ান জেফ। ছোট্ট ক্রিস্টিনাকে কোলে তুলে নেন অফিসার জোয়ান। আর ৩০ বছর আগের সেই মুহূর্তটিতেই যেন ভালবাসার এক সোনালি সুতোয় বাঁধা পড়ে যায় দু’টি জীবন।
ক্রিস্টিনা এখন পড়াশোনা শেষ করে ছোট একটা চাকরি করছেন। তাঁর পড়াশোনার যাবতীয় খরচ সামলেছেন সেই অফিসার জোয়ান জেফ, যিনি এখন পুলিশের সর্বোচ্চ পদাধিকারী মহিলা অফিসার। জোয়ান ও তাঁর নতুন স্বামী এখন ক্রিস্টিনার পালক বাবা-মা। কারণ মাত্র গত বছরই তাঁরা সরকারি ভাবে দত্তক নিয়েছেন মা-হারা ক্রিস্টিনাকে।
জোয়ান ও তাঁর এক সঙ্গী ১৯৮৪-র ১৫ এপ্রিল ঘটনাস্থলে পৌঁছে খুনির খোঁজে ঘরে ঘরে তল্লাশি শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত ক্রিস্টোফার টমাস নামে এক মাদকাসক্তকে আটক করেন তাঁরা। এই সন্দেহভাজনের গুলিতেই ক্রিস্টিনার মা, দুই সৎ ভাই-বোন-সহ ১০ জন প্রাণ হারান। ছোট্ট ক্রিস্টিনাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন জোয়ান। কিন্তু সমাজ কল্যাণ বিভাগ তাঁকে অন্য এক দম্পতির কাছে থাকতে পাঠায়। তার পরে নিজের ঠাকুমা ফেলিসিয়ার সঙ্গেই থাকত মা-হারা মেয়েটি।
কিন্তু সে দিন ঘটনাস্থলে পৌঁছে শুধু কোলে তুলে নিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি পুলিস অফিসার জোয়ান। প্রায় রোজই তিনি আসতেন ক্রিস্টিনাকে দেখতে। তার পরে সময় চলে যায়, ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে সে দিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি। দশ বছর বয়সে পৌঁছে জানতে পারে নিজের মায়ের খুনের ঘটনা। জোয়ানের কোলে নিজের ছবিও দেখে খবরের কাগজের কাটিংয়ে। কিন্তু কী যে টান তার জোয়ানের ওপরে! দু’জনে একে অন্যকে ছেড়ে থাকতে পারেন না। আর এ ভাবেই কেটে গিয়েছে ৩০টা বছর।
শেষ পর্যন্ত গত বছর নিজের নতুন স্বামীকে বলেন জোয়ান “আমাদের তো তিনটি সন্তান রয়েইছে। আর একটি না-হয় বাড়বে। চলো, ক্রিস্টিনাকে দত্তক নিই। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতেই পারবো না।”
সায় দিলেন স্বামী। আর তার পরই ক্রিস্টিনা এখন তার সে দিনের উদ্ধারকারী অফিসারের মেয়ে, সরকারি ভাবেই।
নিউ ইয়র্কের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এই গণহত্যার ৩০তম বার্ষিকী পরশু। সন্দেহভাজন টমাস কিছু দিন জেল খেটে অব্যাহতি পেয়েছে, কারণ সে খুন করেছে নেশার ঘোরে। খুনের কোনও সাক্ষীও মেলেনি। কিন্তু এত মানুষকে এক সঙ্গে খুনের ঘটনা আজও স্মরণ করেন এলাকার মানুষ। এ বার কিন্তু রক্তপাত, প্রাণহানি, অবিচারের অভিযোগ সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠে এল দু’টি মানুষের ভালবাসার এই চিত্তাকর্ষক কাহিনি।