যে দিকেই চোখ যায়, কৃষ্ণ সাগরের ছোট উপদ্বীপটায় উড়ছে শুধু রুশ পতাকা। ভেসে আসছে সোভিয়েত-যুগের গান। ‘আমরা মুক্ত,’ ‘আমরা মুক্ত’ স্লোগান-চিৎকারে কান পাতা দায়। বিতর্কিত গণভোটের পরে ক্রাইমিয়ার রুশপন্থী নেতারা জানিয়েছেন, ৯৭ শতাংশ মানুষ রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পক্ষেই রায় দিয়েছেন। এই ঘোষণার পর থেকেই থমথমে দশা ইউক্রেনের। এই ফলে উৎসাহিত হয়ে রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালাতে পারে, এমন আশঙ্কা অনেকেরই। কেউ কেউ প্রহর গুনছেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও।
গণভোটের ফল প্রকাশ্যে আসতেই তৈরি হয়েছে নতুন জটিলতা। ২০০৮ সালে সার্বিয়া থেকে মুক্ত হয়েছিল কসোভো। তার পরে আর ইউরোপের মানচিত্রে সে ভাবে কোনও পরিবর্তন দেখেনি কেউ। কিন্তু ক্রাইমিয়া রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রশ্নে বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল সমালোচনা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-সহ গোটা পশ্চিমী দুনিয়া জানিয়ে দিয়েছে, গণভোটের এই ফল অবৈধ। পাশাপাশি ব্রাসেলসে দীর্ঘ তিন ঘণ্টার বৈঠকের পরে ইইউ-এর ২৮ জন বিদেশমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন, ২১ জন রুশ ও ইউক্রেনীয় অফিসারের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে। এঁদের সম্পত্তি ফ্রিজ করা হবে এবং চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এই অফিসাররাই ক্রাইমিয়ার গণভোটে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। ইইউ-এর মন্ত্রীরা জানান, আগামী কয়েক দিনে নিষেধাজ্ঞা তালিকায় জুড়বে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন-ঘনিষ্ঠ আরও বেশ কিছু উচ্চপদস্থ অফিসারের নাম।
ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ফোন করে পুতিনকে সাফ জানান, তিনি এবং তাঁর ইউরোপীয় মিত্ররা মস্কোর উপরে অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করার জন্য প্রস্তুত। তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই রাশিয়া এবং ইউক্রেনের ১১ অফিসারের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথাঘোষণা করেন ওবামা। এর মধ্যে ইউক্রেনের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচও রয়েছেন। রয়েছেন পুতিন-ঘনিষ্ঠ দুই অফিসার ভ্লাদিস্লাভ সার্কভ এবং সের্গেই গ্লেজিয়েভ।
বাকি দুনিয়ায় যতই নিন্দা-সমালোচনার ঢেউ উঠুক, ক্রাইমিয়ায় কিন্তু একেবারে অন্য ছবি। মদের ফোয়ারা ছুটিয়ে সেখানে আনন্দে মেতেছেন মানুষ। সেভাস্তোপোলে মাঝবয়সি লুসিয়া প্রোকরোভনা বলছেন, “আলুর বস্তার মতো ক্রাইমিয়ার সঙ্গে জুড়ে ছিল ইউক্রেন। এখন আমরা দখলমুক্ত।” ইউরোপ, আমেরিকার সমালোচনায় বিব্রত না হয়ে ক্রাইমিয়ার এমন মানুষদের ইচ্ছাকেই সম্মান জানিয়েছেন পুতিন। রুশ স্টেট ডুমার ডেপুটি স্পিকার সের্গেই নেভেরভ বলেন, “ক্রাইমিয়ার গণভোটের ফল থেকেই স্পষ্ট এখানকার মানুষ রাশিয়ায় যোগ দিতে চান।” পুতিনের পাশে দাঁড়িয়েছে সে দেশের সংবাদমাধ্যমও। তারা বলছে, ‘আমেরিকাকে শিক্ষা দিতে পারে শুধু রাশিয়াই। ওদের তেজস্ক্রিয় ছাইয়ে পরিণত করার ক্ষমতা রয়েছে রাশিয়ার।’
ক্রাইমিয়ার স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী সের্গি আসিয়োনভ এই ফলকে ‘ঐতিহাসিক’ বলেছেন। ক্রাইমিয়ার লেনিন স্কোয়ারে এক জমায়েতে তিনি বলেন, “আমরা স্বদেশে ফিরছি। ক্রাইমিয়া এ বার থেকে রাশিয়ার অংশ।” তবে সেটা ঠিক কবে হতে চলেছে, সে বিষয়ে এখনও কিছু সিদ্ধান্ত হয়নি। আসিয়োনভের দাবি, ৩০ মার্চের মধ্যেই মস্কোর সঙ্গে জুড়ে যাবে ক্রাইমিয়া। এখানকার স্থানীয় আইনসভা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং অন্য সব দেশের প্রতি ক্রাইমিয়া প্রজাতন্ত্রের আবেদন, আমাদের স্বাধীন দেশ বলে মেনে নিন।’ ক্রাইমিয়ায় নতুন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছে। রাশিয়ার কাছে তিন কোটি ডলার সাহায্য আসবে বলে তাদের আশা।
এই অবস্থায় ইউক্রেন এখন রুশ হানার আশঙ্কায় সেনা তৎপরতা শুরু করেছে। এমনিতেই গত কয়েক দিনে হিংসার ঘটনা ঘটেছে সেখানে। কিয়েভের বাসিন্দা কিরিলো সেগ্রিভ বলছেন, “যুদ্ধ শুরু হতে পারে। ইউক্রেন আর রাশিয়ার মধ্যে নয়। এটা হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ!’ গোটা পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছে ন্যাটো। কারণ ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে আরও একটা বিশ্বযুদ্ধ শুরু হোক চাইছে না কেউই। রুশ আগ্রাসনের মুখে ন্যাটো কিয়েভকে সাহায্য করার কথাই ভাবছে।
ক্রাইমিয়ায় বেশির ভাগ মানুষ গণভোটে উৎসাহী হলেও তাতার এবং মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ খুশি নন। ক্রাইমিয়ার জনসংখ্যার ১২ শতাংশ মানুষ এই দুই সম্প্রদায়ের। শেভকায়ে আসানোভা নামে এমন এক মহিলা জানালেন, “এটা আমার দেশ। আমার পূর্বপুরুষেরও। কে বলল এখানে থাকতে চাই না?” এই ফল তাঁর কাছে অভিশাপের মতো।
ক্রাইমিয়ার মতো রাশিয়ার অংশ হতে চান ইউক্রেনের শিল্পাঞ্চল দনেৎস্কের কেউ কেউ। তাঁরা কিয়েভের সরকারকে মানেন না। তাঁদের সাফ কথা, “এটা ১০০ শতাংশ রাশিয়ার জয়। আমরাও ক্রাইমিয়ার পাশে আছি।”