ধু-ধু চারিদিক। নিস্তব্ধ। হঠাৎ ভোজবাজির মতো একটা ট্রাক এসে দাঁড়াল মরুভূমিতে। তড়িঘড়ি নেমে এল কয়েক জন। বেশির ভাগেরই কাঁধে সাবেক শিকারি রাইফেল, দু’-এক জনের ‘আদ্যিকালের’ একে-৪৭। মরুভূমির তপ্ত বালির উপর পাতা হল কম্বল। তিন-তিনটে পেল্লায় সুটকেস নামানো হল ট্রাক থেকে। এ বার সুটকেস উপুড় করার পালা। কম্বলের উপর ছড়িয়ে পড়ল তাড়া তাড়া ইউরো।
মুক্তিপণের টাকা! মাথার উপরে সূর্যের চেয়েও প্রখর তার ঝলসানি। অপহৃত ৩২টি প্রাণের বিনিময় মূল্য সব মিলিয়ে ৫০ লক্ষ ইউরো!
সময়টা ২০০৩। পর্যায়ক্রমে ৩২ জন পর্যটককে দক্ষিণ আলজেরিয়া থেকে মালিতে অপহরণ করে নিয়ে এসেছিল একটি জঙ্গি গোষ্ঠী। অপহৃতদের বেশির ভাগই
ইউরোপীয়। যাঁদের মধ্যে আবার জার্মানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। নড়ে বসেছিল ইউরোপীয় দেশগুলি। জার্মান সরকারও তদন্তে নেমেছিল। মরুভূমিতে পাথরের আড়ালে রাখা ছিল মুক্তিপণের চিঠি। নীচে স্বাক্ষরকারী নেহাতই অনামী একটি জঙ্গি সংগঠন ‘সালাফিস্ট গ্রুপ ফর প্রিচিং অ্যান্ড কমব্যাট’।
শোনা যায়, জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে মধ্যস্থতা বৈঠক করেছিলেন জার্মান সরকারের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক। রফা হয় ৫০ লক্ষ ইউরোয়। সরকারি ভাবে জার্মানি কোনও দিনই এই মুক্তিপণের কথা স্বীকার করেনি। শুধু বলা হয়েছিল, ওই টাকাটা দেওয়া হয় মালি-র সরকারকে। এবং নেহাতই অনুদান বাবদ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সেই প্রথম বড় দাঁও মারার পর ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করেছিল ওই জঙ্গি সংগঠন। পরে যার নাম হয় ‘আল কায়দা’!
সেই শুরু। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আল কায়দার আড়ে-বহরে বেড়ে ওঠার মূল সমীকরণটা আজও বদলায়নি অপহরণ ও মুক্তিপণ। তবে দরটা বেড়েছে। ২০০৩-এ মাথাপিছু মুক্তিপণের অঙ্কটা ছিল ২ লক্ষ ডলার।
আর এখন আল কায়দা নিজেই অপহৃতের মাথাপিছু ১০ লক্ষ ডলার মুক্তিপণ নেওয়ার কথা খুল্লমখুল্লা ঘোষণা করছে। তাদের আরব-শাখার অন্যতম প্রধান নাসির আল-উওহেসি সম্প্রতি লিখিত ভাবেই স্বীকার করেছেন, এই ‘লাভজনক ব্যবসা’র কথা। যেখানে অপহৃতদের ধরে ধরে কোতল করা নয়, মুক্তিপণ আদায়ই পাখির চোখ।
কী ভাবে চলে এই গোটা প্রক্রিয়া? পাথর চাপা দেওয়া মুক্তিপণের চিঠি আজ সেকেলে। আল কায়দার হাতে আজ স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক। অপহৃতদের দিয়েই ভিডিও বার্তায় তাঁদের দেশের সরকারের কাছে মুক্তিপণ চাওয়ানো হয়। ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁসের’ মতোই আদর-যত্ন করা হয় বন্দিদের। থাকে মেডিক্যাল টিম। দাবি মিটলেই মুক্তি।
এই অপহরণ-ব্যবসারও একটা বিশেষ ধাঁচ লক্ষ করা যাচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোন কোন দেশ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা সম্ভব, বুঝে গিয়েছে আল কায়দা। মুক্তিপণ দেওয়ার ব্যাপারে ব্রিটেন এবং আমেরিকা বরাবরই গররাজি। তাই বেছে বেছে অপহরণ করা হচ্ছে ব্রিটেন বাদে বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের নাগরিকদের। গত পাঁচ বছরে আল কায়দার বিভিন্ন শাখা সংগঠন যে ৫৩ জনকে বিভিন্ন সময়ে অপহরণ করেছে, তার মধ্যে মার্কিন নাগরিক মাত্র তিন জন! ‘জেনিভা সেন্টার ফর ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যানালিসিস টেররিজম’-এর অধিকর্তা জিয়েন পল বলেন, “পুরোটাই তো বিনিয়োগের মতো। ওরা জানে, চাইলেই আমেরিকা থেকে মুক্তিপণের সুটকেস মিলবে না। তাই ওদের লক্ষ্য শুধুই ইউরোপীয়রা।”
মজার কথা, মুক্তিপণ দেওয়ার বিরোধিতায় বেশ কিছু দেশ একাধিক বার চুক্তি সই করেছে। এমনকী সাম্প্রতিক জি-৮ শীর্ষ বৈঠকেও এই সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে সহমত হয়েছিল ইউরোপীয় দেশগুলি। তার পরেও অভিযোগ ওঠে, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, সুইৎজারল্যান্ডের মতো দেশ এখনও মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে চলেছে আল কায়দাকে। অথচ মুক্তিপণ দেওয়ার কথা স্বীকার করে না কেউই।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি অন্তর্তদন্ত বলছে, ২০০৮ থেকে মুক্তিপণ বাবদ আল কায়দা মূলত ইউরোপীয় দেশগুলি থেকেই আদায় করেছে অন্তত ১২ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার। যার মধ্যে ৬ কোটি ৬০ লক্ষ ডলার শুধু গত বছরেই। স্বভাবতই এ নিয়ে উষ্মা জানিয়েছেন কেউ কেউ। প্রাক্তন মার্কিন আমলা ভিকি হাডলসনের কথায়, “এক দিকে মুক্তিপণ দেব, অথচ স্বীকারও করব না, ইউরোপের এই দ্বিচারিতা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”
‘ব্যবসা’ কিন্তু চলছে। এবং রমরমিয়ে!