একটা আণুবীক্ষনিক ভাইরাস মৃত্যুভয়ের কাঁপুনি ধরিয়ে দিল প্রকাণ্ড এই পৃথিবীর কোনা থেকে কোনায়। হাজারে হাজারে কফিনের লাইন, গণকবর, গণচিতা— এমন দৃশ্য বিশ্ব সম্প্রতি দেখেনি। ‘মহাশক্তিধর’ আমেরিকা অসহায় হয়ে দেখছে। ‘মহাশক্তিধর’ বিজ্ঞান এক বছরে কাবু করতে পারেনি কোভিড-১৯কে। অদ্ভুত একটা বছর। ভয়ঙ্কর একটা বছর। এই চিত্র-প্রতিবেদনে আনন্দবাজার ডিজিটাল বেছে নিল বছরের প্রত্যেকটা মাসের বিশ্বের একটা করে সেরা ছবি। সেই মাসের ছবি। সেই মাসের-কথা বলা ছবি।
বিপদের শুরু ডিসেম্বর থেকে। আতঙ্ক হয়ে দাঁড়াল জানুয়ারিতে। অস্ট্রেলিয়ার দাবানলও তাই, চিনের ভাইরাস সংক্রমণও তাই। বহু বন্যপ্রাণ কেড়ে নিয়ে দাবানল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে মে মাসে। কিন্তু করোনার মারণগ্রাস চিন থেকে ছড়িয়ে পড়ার পর সারা পৃথিবীকে এখনও জর্জরিত করে রেখেছে। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর সোশ্যাল মিডিয়ায় অজানা এক ভাইরাস নিয়ে সতর্কবার্তা পোস্ট করেন চিনের চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং। তার পর সে দেশের গবেষকরা আবিষ্কার করেন, ওই ভাইরাস থেকে ইতিমধ্যেই মানবশরীরে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। ১১ জানুয়ারি চিনে ওই ভাইরাস ঘটিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রথম এক রোগীর মৃত্যু হয়। ২৩ জানুয়ারি উহানে সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষিত হয়। ২১ জানুয়ারি আমেরিকায় প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। ৩০ জানুয়ারি পৃথিবী জুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)।
দু’সপ্তাহের মধ্যে উহানে কোভিড হাসপাতাল গড়ে নজির চিনের। ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সেই প্রথম এক করোনা রোগীর মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসে। প্যারিসের একটি হাসপাতালে ৮০ বছর বয়সি এক চিনা পর্যটকের মৃত্যু হয়। এশিয়ার বাইরে করোনার প্রকোপে সেটাই প্রথম মৃত্যু। আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকায় ইটালিতে ১০টি শহরে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি আমেরিকায় প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু। সেখানে সংক্রমণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭ হাজারে। দেশবাসীকে ইটালি, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ভাইরাস কবলিত দেশে যেতে নিষেধ ট্রাম্প সরকারের।
করোনার প্রকোপ ঠেকাতে প্রথম দফায় ২১ দিনের লকডাউনের ঘোষণা ভারতে। ২৬ মার্চ চিন, ইটালি-কে টপকে সংক্রমণের নিরিখে বিশ্বতালিকায় শীর্ষে আমেরিকা। তখনও পর্যন্ত সেখানে ৮১ হাজার ৩২১ জনের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়েছিল। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন ১ হাজারের বেশি মানুষ। ৩০ মার্চ আমেরিকার ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড, ওয়াশিংটন ডিসি-সহ বেশ কিছু জায়গায় মানুষজনকে বাড়ির বাইরে না বেরনোর পরামর্শ প্রশাসনের।
লকডাউনের জেরে ইটালিতে দৈনিক মৃত্যুতে খানিকটা লাগাম। কিন্তু আমেরিকায় পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। প্রায় ৮ হাজার মানুষের তত দিনে মারা গিয়েছেন। নোভেল করোনার প্রকোপে প্রতিদিন এত সংখ্যক রোগীর মৃত্যুতে মর্গে জায়গা হচ্ছিল না। বেওয়ারিশ দেহ সরাতে তাই গণকবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। থরে থরে কফিনবন্দি দেহ নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড সাউন্ডের পশ্চিম প্রান্তের হার্ট আইল্যান্ডের মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। এক একটি গর্তে ২০-২৫টা করে কফিন কবর দেওয়া হয় সেই সময়। ড্রোন ফুটেজে গণকবর দেওয়ার সেই দৃশ্য দেখে চমকে উঠেছিল গোটা বিশ্ব। ২৬ এপ্রিল গোটা বিশ্বে করোনার প্রকোপে মৃত মানুষের সংখ্যা ২ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।
এ সবের মধ্যেই বর্ণবিদ্বেষের নক্ক্যারজনক ঘটনা আমেরিকার মিনিয়াপলিসে। হাঁটু দিয়ে গলা চেপে ধরে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে নৃশংস ভাবে হত্যা এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্মীর। চেক জালিয়াতির অভিযোগে রাস্তায় ফেলে জর্জের উপর নৃশংস অত্যাচার চালানো হয়। হাঁটু দিয়ে তাঁর গলা চেপে বসে থাকেন অভিযুক্ত পুলিশ কর্মী। আরও দুই পুলিশকর্মী জর্জের পিঠ চেপে ধরে বসেছিলেন। হৃদরোগের সমস্যা ছিল জর্জের। কাতর কণ্ঠে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আর পারছি না। মরে যাচ্ছি আমি।’’ তাতেও নিস্তার মেলেনি। ওই অবস্থায় ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় জর্জের। এক পথচারীর মোবাইলের ক্যামেরায় গোটা ঘটনাটি ধরা পড়ে।
জর্জ ফ্লয়েড হত্যার ঘটনায় উত্তাল গোটা আমেরিকা। জর্জের শেষ বাক্য উদ্ধৃত করে, ‘শ্বাস নিতে পারছি না’ (আই কান্ট ব্রিদ) লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দলে দলে রাস্তায় নামেন প্রতিবাদী মানুষ। অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে ‘থার্ড ডিগ্রি’ খুনের মামলা দায়ের করা হলেও ক্ষোভ মেটেনি সাধারণ মানুষের। সোশ্যাল মিডিয়াতেও ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের রেশ পৌঁছে যায়। বিক্ষোভ থামাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সঙ্ঘর্ষ বেধে যায় আন্দোলনকারীদের। তাতে পরিস্থিতি হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। শহরে-শহরে চলে দোকান ভাঙচুর, পুলিশের গাড়িতে আগুন, এমনকি থানা ভাঙচুরও। গোটা ঘটনার জন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণকেও দায়ী করেন অনেকে।
শুরুর দিকে দৈনিক সংক্রমণ ২০ থেকে ৩০ হাজারের মধ্যে ঘোরাঘুরি করলেও, জুলাই মাসে ব্রাজিলে দৈনিক সংক্রমণ প্রথম বার ৬০ হাজারের গণ্ডি ছুঁয়ে ফেলে। চিনের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা ট্রাম্প সরকারের। ১০ জুলাই একধাক্কায় ৬৮ হাজার নতুন সংক্রমণ আমেরিকায়। শুরুর দিকে করোনাকে গুরুত্ব না দিলেও, ১১ জুলাই প্রথম বার মাস্ক পরে জনসমক্ষে দেখা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।
৪ অগস্ট পর পর জোরাল বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে লেবাননের রাজধানী বেইরুট। বেইরুটের বন্দর এলাকায় বিস্ফোরণটি ঘটে। এর তীব্রতা এতটাই ছিল যে ১০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মৃত্যু হয় ২০৪ জনের। জখম হন প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মানুষ। জানা যায়, যে এলাকায় এই বিস্ফোরণ ঘটে সেখানে ২০১৪ সাল থেকে প্রচুর পরিমাণে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত রাখা ছিল। জর্জিয়া থেকে মোজাম্বিকগামী একটি জাহাজ আইনি জটিলতায় বেইরুটে আটকে পড়েছিল, সেই জাহাজেই ছিল এত রাসায়নিক। কোনও ভাবে গুদামে আগুন লেগে গেলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে।
করোনা রুখতে নিজেদের তৈরি ‘স্পুটনিক-ভি’ প্রতিষেধককে জনসাধারণের উপর প্রয়োগে ছাড়পত্র রাশিয়ার। তার এক মাস আগেই অবশ্য ‘স্পুটনিক-ভি’-কে সরকারি ছাড়পত্র দিয়ে দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। নিজের মেয়ের উপর প্রতিষেধকটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। ২৯ সেপ্টেম্বর গোটা বিশ্বে করোনায় মৃতের সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। এর অর্ধেক মৃত্যুই আমেরিকা, ভারত এবং ব্রাজিলে ঘটেছে বলে জানায় আমেরিকার জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি। সেই সময় বিশ্বের ১৮৮টি দেশ করোনার প্রকোপে ছিল।
চিনের উহানে নোভেল করোনা হানা দেওয়ার ১০ মাসের মাথায়, গত ২৪ অক্টোবর গোটা বিশ্বে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৫ লক্ষে গিয়ে ঠেকে। আবার ৩০ অক্টোবর তা বেড়ে ৭ লক্ষ ১৭৭ হয়। মোট সংক্রমণের ৬৬ শতাংশই ছিল ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং লাতিন আমেরিকায়।
চার বছরেই হোয়াইট হাউসে থাকার মেয়াদ শেষ হল ডোনাল্ড ট্রাম্পের। তাঁকে হারিয়ে গত ৭ নভেম্বর আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জো বাইডেন। ৩০৬টি ইলেক্টরাল ভোট পান তিনি। ট্রাম্প পান ২৩২টি। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বাইডেন বারাক ওমাবার আমলে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট বেছে নিয়েছেন তিনি। আগামী ২০ জানুয়ারি তাঁদের শপথগ্রহণ। তবে এখনও হার স্বীকার করতে রাজি নন ট্রাম্প। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বলে শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন তিনি। তার জন্য আইন-আদালত পর্যন্ত ছুটে গিয়েছেন। কিন্তু সব জায়গা থেকেই খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে।
জরুরি পরিস্থিতিতে ফাইজারের তৈরি প্রতিষেধক প্রয়োগে অনুমোদন দিল ব্রিটেন। মার্কিন সংস্থা ফাইজার এবং জার্মান সংস্থা বায়োএনটেক যৌথ ভাবে এই প্রতিষেধকটি তৈরি করেছে। গত ১ ডিসেম্বর সেটিকে ছাড়পত্র দেয় ব্রিটেনের নিয়ামক সংস্থা। কোভিডঘটিত রোগ নিরাময়ে ফাইজারের তৈরি প্রতিষেধক ৯৫ শতাংশ কার্যকর বলে জানিয়েছে তারা। তবে করোনার প্রতিষেধক নিয়ে এই মুহূ্র্তে যে প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্ব জুড়ে তাতে সকলকে টপকে সাত তাড়াতাড়ি ফাইজারের প্রতিষেধককে ছাড়পত্র দেওয়ায় সমালোচনার মুখেও পড়তে হচ্ছে ব্রিটেনকে।