প্যারিসের রাস্তায় মিছিল। মঙ্গলবার।
তখন বেলা একটা হবে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। গেলাম পোন্ডেন্যুলি টিউব স্টেশনে। এক বার বদলে টিউব রেলে (আমাদের মেট্রো) চেপে যেতে হবে ভাবা স্টেশনে।
সেন নদীর প্রায় গাঁ ঘেষেই ন্যুই সুর সেন এলাকা। আমাদের বাড়িটা সেখানেই। বেশ নিরিবিলি, ছিমছাম এলাকা। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে টিউবে চেপে ভাবা স্টেশনে পৌঁছতে লাগে পাক্কা ৪৫ মিনিট। ফরাসি ভাষা শিখতে যাই। ওখানকার একটা ইনস্টিটিউটে।
হঠাৎই টিউবে ঘোষণা করা হল, ট্রেনটি ভাবা স্টেশন পর্যন্ত যাবে না। নেমে যেতে হবে তার ঠিক আগের স্টেশন মন্তপারনাসে। কেন যাবে না, তা অবশ্য জানানো হল না। ভাবলাম, হয়তো ইউরোর ম্যাচ আছে। তাই নিরাপত্তার জন্য ওই স্টেশনে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত লোকজনকে যাওয়া-আসা করতে দেওয়া হচ্ছে না।
যাই হোক, আমার ইনস্টিটিউটে যাওয়ার খুব তাড়া ছিল। তাই মন্তপারনাস স্টেশনে নেমেই পড়িমরি করে ছুটব বলে সবে পা ফেলেছি রাস্তায়। আর রাস্তায় পা ফেলেই চমকে গেলাম। দেখলাম শ’য়ে শ’য়ে পুলিশে ঘিরে ফেলেছে মন্তপারনাস স্টেশনের সামনের রাস্তাটাকে। রাস্তাটার নাম রু মন্তপারনাস। সেখানে সার সার দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে পুলিশের গাড়ি। সাইরেন বাজিয়ে দু’-একটা পুলিশের গাড়ি সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। টানা তিন বছর প্যারিসে রয়েছি। প্যারিসে কোথাও একই জায়গায় এত পুলিশ মোতায়েন হতে দেখিনি! আমার সঙ্গে আমার এক বান্ধবীও ছিল। সে-ও আমার সঙ্গে ওই ইনস্টিটিউটে যায় ফরাসি ভাষা শিখতে। অত পুলিশ দেখে ও তো খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল! আমাকে বলল ‘‘হয়েছেটা কী?’’
আরও পড়ুন- ভূত কি সর্ষের মধ্যেই? অরল্যান্ডো নিয়ে তরজায় ট্র্যাম্প-ওবামা-হিলারি
কী যে হয়েছে, আমিও কি ছাই বুঝতে পেরেছি তখন?
দেখলাম, ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে কয়েক হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিশাল বড় একটা মিছিল সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। বিভিন্ন দিকে থেকে লোকজন আসছে সেই মিছিলে যোগ দিতে। তাই ওই রাস্তার লাগোয়া অন্য রাস্তাগুলোতে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর ওই রাস্তাগুলোর মুখেও মিছিলে আসা মানুষের বড় জটলা। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেই জটলা। তবে কোনও অস্বাভাবিকতার ছোঁয়া দেখিনি তখনও ওঁদের চোখে-মুখে। তাদের হাতে ধরা বড় বড় পোস্টার। খবর নিয়ে জানলাম, ওঁরা ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় শ্রমিক ইউনিয়ন- সিজিটি’র সদস্য, কর্মী, সমর্থক। জমায়েতে থাকা শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে দেখলাম প্রচুর কৃষ্ণাঙ্গকেও। খবরের কাগজে পড়েছি, ওঁরা বেশ কিছু দিন ধরেই প্যারিস সহ ফ্রান্সের বেশ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে্ন। ধর্মঘটে ধর্মঘটে অচল করে দিয়েছেন প্রচুর কলকারখানা। ফ্রান্সের নতুন শ্রম সংস্কার আইনের প্রতিবাদেই শহরে শহরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন শ্রমিকরা।
সে যা-ই হোক, ওই ভিড় আর জটলার ফাঁক গলেই রাস্তা ধরে আমি আর আমার বান্ধবী পৌঁছে গেলাম আমাদের ফরাসি ভাষা শেখার ইনস্টিটিউটে। রাস্তায় এত সব দেখতে দেখতে আমাদের যে একটু দেরি হয়ে গেছে! তাই ইনস্টিটিউটে পৌঁছে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে গেলাম ক্লাস করতে। কিন্তু কপাল মন্দ! আমাদের টিচার আসেননি আজ, তাই কোনও ক্লাসই হল না।
ফলে, আবার বাড়ি-মুখো হলাম। ইনস্টিটিউটের বাড়ি থেকে নেমে আসতেই দেখি, রাস্তায় ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটছে। আমাদের ইনস্টিটিউটটা যেখানে, সেখানে প্রচুর দোকানপাট, শপিং মল আর রেস্তোরাঁ রয়েছে। সেগুলো ভাঙচুর করা হচ্ছে। ভাঙা হচ্ছে দোকানের কাচ, রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়ির কাচও। তাদের হাতে হরেক রঙের প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন। সেগুলোর কোনওটাতে লেখা ‘ট্যুরিস্ট গো হোম’, কোনওটাতে লেখা ‘দিস ইজ ফর রিফিউজি’। দেখলাম, পুলিশের সঙ্গে ওঁদের কার্যত, খণ্ডযুদ্ধ চলছে। পুলিশ ওঁদের হঠাতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুঁড়ছে। চালিয়েছে জল কমান। বোমা, পটকা পড়ছে এক নাগাড়ে।
দোকান ভাঙচুর। প্যারিসের রাস্তায়। মঙ্গলবার।
পরে পুলিশের কাছে থেকে জানতে পারলাম, প্রায় ৭৫/৮০ হাজার শ্রমিক আজ জমায়েত হয়েছিলেন ওই রাস্তায়। প্রায় আড়াই, তিন ঘণ্টা ধরে চলেছে ওঁদের বিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীদের ছোঁড়া ইট পাথরের আঘাতে ২৯ জন পুলিশ অফিসার জখম হয়েছেন। পুলিস ৪২ জনকে গ্রেফতার করেছে।