অর্থ এবং সামরিক শক্তিতে ইজরায়েলের সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না, তা ঢের আগেই বুঝে গিয়েছিল হামাস। তাই মাটির নীচে জাল বিস্তার করতে শুরু করেছিল তারা। বছরের পর বছর ধরে গাজা থেকে ইজরায়েলের উপকণ্ঠ পর্যন্ত শিকড়ের মতো সুড়ঙ্গ বিস্তার করেছিল তারা।
কিন্তু শুক্রবার গভীর রাতে ৪০ মিনিট ধরে একনাগাড়ে ৪৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে তার বেশির ভাগ গুঁড়িয়ে দিল ইজরায়েলি সেনা। ক্ষেপণাস্ত্রর পাশাপাশি ১ হাজার বোমা এবং গোলাও ছুড়েছে ইজরায়েল। তাতে এত বছর ধরে গড়ে তোলা মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে অবস্থিত হামাসের সুড়ঙ্গপথের একটা বড় অংশ ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে।
তবে মুখোমুখি যুদ্ধে এই অসাধ্য সাধন হয়নি। বরং তার জন্য ছল-চাতুরির আশ্রয় নিতে হয়েছে ইজরায়েলি বাহিনীকে। শুক্রবার মধ্যরাতে আচমকাই ইজরায়েলি সেনা ঘোষণা করে যে, তাদের স্থলবাহিনী সরাসরি গাজায় হামলা করতে চলেছে।
এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই গাজা থেকে সুড়ঙ্গ পথ ধরে দলে দলে যোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র সমেত ইজরায়েলের উদ্দেশে পাঠাতে শুরু করে হামাস। কিন্তু আকাশ পথে আগে থেকেই বোমারু বিমান, ক্ষেপাণাস্ত্র এবং গোলাগুলি নিয়ে তৈরি ছিল ইজরায়েলি বাহিনী।
গুপ্তচর মারফত যেই না সুড়ঙ্গ পথে হামাস যোদ্ধাদের প্রবেশের খবর মেলে, এলোপাথাড়ি ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমা বর্ষণ করতে শুরু করে তারা। তাতেই যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই হেরে বসে হামাস। এর পর ইজরায়েলি সেনার এক মুখপাত্র ঘোষণা করেন, তাঁদের কোনও সেনাই সীমানা পার করেনি। তা না করেই লক্ষ্যপূরণ হয়েছে।
‘ইজরায়েলি আগ্রাসন’-এর হাত থেকে প্যালেস্তাইনকে রক্ষার জন্য গত ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে লড়াই করে চলেছে সুন্নি ইসলামিক সংগঠন হামাস। ইজরায়েল এবং আমেরিকার মতো দেশ তাদের জঙ্গি সংগঠন বললেও, রাশিয়া, চিন এবং ইরানের মতো দেশ তাদের দাবিদওয়াকে সমর্থন করে।
প্যালেস্তাইনের অন্যত্র ইজরায়েলি আগ্রাসন প্রবেশ করলেও গাজায় তাদের ঠেকিয়ে রেখেছে এই হামাসই। হাতে মারতে না পেরে ভাতে মারার কৌশলও নিয়েছে ইজরায়েল। অর্থনৈতিক ভাবে গাজাকে একেবারে কোণঠাসা করে রেখেছে তারা। বহির্জগতেরর সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য হয়ই না গাজার। যে কারণে সেখানে বেকারত্বের হার প্রায় ৫০ শতাংশ।
নিষেধাজ্ঞার জেরে ব্যবসা-বাণিজ্যের এই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে ২০০৭ সাল নাগাদ মাটির নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শুরু হয় গাজায়। প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ওই সুড়ঙ্গ পথ ধরে পড়শি দেশ মিশর থেকে গোপনে পণ্য আদান প্রদান করা। যদিও তার আগে ২০০২ সালে বেশ কিছু এলাকা জুড়ে সুড়ঙ্গপথ গড়ে তোলা হয় সেখানে। এর মধ্যে একটি ব্যবহার করেই ২০০৪ সালে ইজরায়েলি সেনার উপর হামলা চালানো হয়।
২০১৩ সালে ইজরায়েল-গাজা সীমান্তের ঠিক নীচে তিনটি আলাদা আলাদা সুড়ঙ্গ পথ গড়ে তোলা হয়। খান ইউনিস, জাবালিয়া এবং শাতি শরণার্থী শিবির হয়ে সেগুলি ইজরায়েলের ভিতরে গিয়ে শেষ হয়। হামাস ছাড়াও, বিভিন্ন প্যালেস্তিনীয় চরমপন্থী সংগঠন ওই সুড়ঙ্গপথ নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। এমনকি ওই সুড়ঙ্গেই ক্ষেপণাস্ত্র, বোমা, অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখা হতো। পরে আরও বিস্তার লাভ করে ওই সুড়ঙ্গপথ।
ওই সুড়ঙ্গপথ থেকেই সংগঠনের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করা হতো। সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যরাও বিপদে ওই সুড়ঙ্গেই আশ্রয় নিত। সেখান থেকেই হামলা করা হত। ২০১৪ সালে ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে ওই সুড়ঙ্গপথেই যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করে হামাস। হামলা চালিয়ে ওই পথ ধরেই ফিরে যেত হামাস।
তবে সুড়ঙ্গপথেও সে ভাবে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারেনি হামাস। বরং ২০১৪-র যুদ্ধে ২ হাজার ২৫১ জন প্যালেস্তিনীয়র মৃত্যু হয়। ইজরায়েলের তরফে প্রাণহানি ঘটে মাত্র ৭৪ জনের। সব মিলিয়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন। ঘরছাড়া হন ১০ হাজারের বেশি মানুষ।
সেই সময় ৩২টি সুড়ঙ্গ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল বলে জানায় ইজরায়েল। সুড়ঙ্গপথে হামাসকে রুখতে মাটির নীচে আলাদা করে ৪১ মাইল দীর্ঘ কংক্রিটের সীমান্তও গড়ে তোলে তারা। তাতে সেন্সর বসানো হয়, যাতে মাটির নীচে যে কোনও গতিবিধি ধরা পড়ে।
কিন্তু সেই সেন্সর এড়িয়েও হামাস নতুন করে সুড়ঙ্গপথ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় বলে জানা গিয়েছে। শুক্রবার রাতে সেগুলিই ধ্বংস করে দিয়েছে ইজরায়েলি বাহিনী। তার তীব্রতায় গাজার রাস্তাঘাটও চৌচির হয়ে গিয়েছে। তবে ঠিক কতজনের প্রাণহানি ঘটেছে, তা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি।