আলাস্কা। নামটা শুনলেই দিগন্তবিস্তৃত তুষার প্রান্তর, ইগলু, এস্কিমো, ছ’মাস দিন-ছ’মাস রাতের এক হিমশীতল দেশের ছবি মনে ভেসে ওঠে। কিন্তু যাঁরা আলাস্কা দেখেছেন, তাঁরাই জানেন যে বাস্তবে এই ছবিটা কতটা আলাদা। আলাস্কা আমেরিকার ৫০টি রাজ্যের মধ্যে ৪৯তম। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সব আছে। তবু যেন ‘মায়াবী’ এক দুনিয়া। সুসজ্জিত আর মনকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। মধ্যরাতের সূর্য এবং অরোরা বোরিয়ালিস-এর ঠিকানা। গ্রিজ়লি ভালুক, কোডিয়াক ভালুক, সাদা ভালুক, বোল্ড ইগল, তিমি মাছ, সিল মাছ, সি ওটার, মুস, ক্যারিবুর মতো অজস্র পশুপাখির আস্তানা আলাস্কা। বিশ্বের অন্যতম বৈচিত্রময় বাস্তুতন্ত্র এবং খনিজ সম্পদে ভরপুর এই অঞ্চল। এখানেই রয়েছে উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ— মাউন্ট ডেনালি (মাউন্ট ম্যাকিনলে)।
২০০৯-এ ‘ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা, ফেয়ারব্যাঙ্কস’-এ গবেষণা করতে না-এলে এ সবের অনেকটাই হয়তো অজানা থেকে যেত। দীর্ঘ দশ বছরে আমি আলাস্কার অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী— শুধু ইন্টারন্যাশনাল আর্কটিক রিসার্চ সেন্টারের এক জন জলবায়ু বিজ্ঞানী হিসেবে নয়, সাধারণ মানুষ হিসেবেও।
শীতকালে তীব্র ঠান্ডা এবং গ্রীষ্মে মনোরম গরমই আলাস্কার আবহাওয়ার মূল বৈশিষ্ট্য। ২০০৯-এর জুলাইয়ে ফেয়ারব্যাঙ্কসে প্রথম বার ২৪ ঘণ্টা সূর্যের আলো দেখে খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম। বেলা ১১টায় রোদ, আবার রাত ৩টে-তেও ঝলমলে চারদিক। ঘড়ি দেখে ঘুমোতে যাওয়া, ঘুম থেকে ওঠা। শীতকালে আবার ঠিক উল্টো। তখন মাত্র ৩-৪ ঘণ্টা সূর্যের আলো। ফেয়ারব্যাঙ্কসে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার তারতম্য দেখা যায়। আমি এখানে শীতকালে মাইনাস ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে দেখেছি, যখন ফুটন্ত জল শূন্যে ছুড়ে দিলে বরফ হয়ে মাটিতে পড়ে। আবার গরমের দিনে তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসও হয়। তখন শুকনো গরম আবহাওয়ায় জঙ্গলে আগুন লেগে যায়। এমনিতে মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠান্ডার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য বোঝা যায় না। কিন্তু মাইনাস ৪০ ডিগ্রি (সেলসিয়াস বা ফারেনহাইট) হলেই ঠান্ডাটা অন্য রকম হয়ে যায়। বেশি ক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখের জল জমে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। চোখের পাতা, ভুরু সব জমে সাদা। বেশি ক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকলে মুখের ভিতরে জিভ, গাল সব জমে আড়ষ্ট হয়ে যায়।
এখন এই বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে শীতকালের তীব্রতা এবং দৈর্ঘ্য দুটোই হ্রাস পেয়েছে। আগে শীতকালে দু’-তিন বার তীব্র শৈত্যপ্রবাহ আসত ও টানা সাত-আট দিন মাইনাস ৪০ ডিগ্রির নীচে তাপমাত্রা থাকত। এখন শীতে হয়তো এক দিন মাইনাস ৪০ ডিগ্রির নীচে তাপমাত্রা নামে। ২০১৫-১৬ সালে তাপমাত্রা মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচেই নামেনি!
কেন এই পরিবর্তন? জলবায়ুর এই পরিবর্তন এক দিনে কিন্তু আসেনি, ধীরে ধীরে এসেছে। আমাদের আগেই সচেতন হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হইনি। সারা পৃথিবীর সঙ্গে আলাস্কাতেও উষ্ণায়নের প্রভাব পড়েছে। উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জল গরম হচ্ছে। মেরু অঞ্চলের সমুদ্রের বরফ অত্যন্ত দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে, হিমবাহও গলে যাচ্ছে। আলাস্কা ও রাশিয়ার মধ্যে অবস্থিত বিউফোর্ট সমুদ্র অঞ্চলে বছরের সর্বোচ্চ বরফ থাকার কথা মার্চ মাসে। কিন্তু এ বছর ফেব্রুয়ারি
মাসেই বিউফোর্ট সমুদ্র প্রায় বরফশূন্য হয়ে গিয়েছে।
প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে তার প্রভাব আবহাওয়াতে পড়তে বাধ্য। সুমেরু অঞ্চলের সমুদ্রের বরফ দ্রুত গলে যাওয়ার ফলে সমুদ্রের সঙ্গে সঙ্গে বায়ুপ্রবাহের ধরনেও পরিবর্তন আসছে। এর ফলে বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে বয়ে চলা জেট স্ট্রিম বা শীতল বায়ুস্রোতের মধ্যে অস্বাভাবিকতা তৈরি হচ্ছে। যেখানে শীতকালে বরফ পড়ার কথা, সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে। যেখানে বরফ পড়ার কথা নয়, সেখানে তুষারঝড়ে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ফেয়ারব্যাঙ্কসে শীতের রাতে আকাশ পরিষ্কার থাকলে খুবই ঠান্ডা পড়ে। কারণ, ভূপৃষ্ঠ দ্রুত তাপ বিকিরণ করে মাটিকে ঠান্ডা করে দেয়। কয়েক বছর ধরে শীতকালে আকাশ মেঘলা থাকছে, এমনকি বৃষ্টিও হচ্ছে। শীতকালে বৃষ্টি হলে জল মাটিতে পড়ে জমে যায়। এর ফলে রাস্তায়, ফুটপাতে স্বচ্ছ বরফের আস্তরণ তৈরি হয়। যাকে বলে ‘ব্ল্যাক আইস’। তখন গাড়ি চালানো বা হাঁটাচলা করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এখন শীতকালের স্থায়িত্ব কমে গিয়েছে। আগে জুন পর্যন্ত বরফ থাকত। ২০১০ সালের ৬ জুন প্রবল তুষারপাত দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। এখন এপ্রিল বা কখনও মার্চের শেষেই বরফ গলে যাচ্ছে।
গরমকালে আলাস্কার অন্যতম প্রধান সমস্যা দাবানল। শুকনো গরম আবহাওয়ায় খুব সহজেই জঙ্গলে আগুন লেগে যায়। গত কয়েক বছরে দাবানলের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সপ্তাহখানেক আগে প্রায় টানা সাত দিন দাবানলের ধোঁয়ায় ঢাকা ছিল ফেয়ারব্যাঙ্কস। এ সবই উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
অনেকের মনে হতে পারে যে, শীতকালে কম ঠান্ডা তো ভালই! কিন্তু এক জন জলবায়ু বিজ্ঞানী হিসেবে বলতে পারি যে, স্বাভাবিকের বাইরে কোনও কিছুই ভাল নয়। ঠান্ডা জায়গায় ঠান্ডা পড়া জরুরি। না-হলে শুধু মানুষ নয়, সমস্ত পশুপাখি, উদ্ভিদকে নিয়ে গড়ে ওঠা বাস্তুতন্ত্রের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।
জলবায়ুর এই পরিবর্তন যেমন এক দিনে আসেনি, তেমনই এই ভারসাম্যহীনতাকে এক দিনে স্বাভাবিক করাও সম্ভব নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আইপিসিসি-র রিপোর্ট মেনে আমাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর চেষ্টা করা উচিত। তা ছাড়া, গাছ লাগানো ও বনজঙ্গল রক্ষা করা প্রয়োজন। কারণ মানুষ এই পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী, যারা পৃথিবীটাকে আস্তে আস্তে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একটা বা দু’টো দেশ সচেতন হলে হবে না, পুরো পৃথিবীকেই সচেতন হতে হবে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক, যে গ্রহে আমরা বসবাস করি, সেই গ্রহের খেয়াল রাখাকে আজ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
লেখক জলবায়ু বিজ্ঞানী, বর্তমানে কানাডায় কর্মরত