২০২০-এর ২১ মার্চ যখন দিল্লি থেকে নিউ ইয়র্কে পৌঁছলাম, জন এফ কেনেডি বিমান বন্দরকে কেমন যেন পরিত্যক্ত, অবহেলিত বলে মনে হল। আমার সহযাত্রী তিনজনই নিউ ইয়র্ক থেকে বস্টনের উড়ানে আমার সঙ্গী হলেন। বিজ্ঞান, বিশেষত চিকিৎসাবিজ্ঞানে পৃথিবীতে সবথেকে এগিয়ে থাকা দেশটি যেন অতিমারির পরবর্তী মাসগুলোয় ওয়াশিংটনের অযোগ্য ও সংবেদনহীন প্রশাসনের অপদার্থতায় দুমড়ে পড়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবৈষম্যের কারণে দুর্বল সংখ্যালঘুরা অপরিসীম দুর্দশার শিকার হয়েছেন। কোনও পরিসংখ্যানের তোয়াক্কা না রেখে পোকামাকড়ের মতো মারা গিয়েছেন।
এমন এক অভাবনীয় সামাজিক পীড়নের পরিস্থিতিতে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের এক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে গলায় হাঁটু দিয়ে চেপে মেরে ফেলার ঘটনায় আদর্শবাদী তারুণ্যের বর্ণময় প্রতিবাদের তরঙ্গ আমেরিকার শহরগুলিতে আছড়ে পড়ল।
৬ নভেম্বর যখন নিউইয়র্ক থেকে দিল্লির বিমান ধরার তোড়জোড় করছি, তখন টিভির পর্দায় ভেসে উঠছে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পেনসিলভেনিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্টেটে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে টপকে জো বাইডেনের এগিয়ে যাওয়ার খবর। ট্রাম্পের দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফেরার মতো বিপর্যয়কে এড়ানো গিয়েছে। সহ-অধ্যাপক ও ছাত্রদের মতো আমার মধ্যেও একটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মতো অনুভূতি হল বটে। কিন্তু খুব যে উচ্ছ্বসিত হলাম, বলা যাবে না। অতিমারি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলছে। আমেরিকার বর্ণবৈষম্য এখনও আনুভূমিক ভাবে ভাগ করে রেখেছে সেখানকার সমাজকে।
তা সত্ত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্প-মাইক পেন্সকে হারিয়ে বাইডেন-কমলা হ্যারিসের বিজয় আমেরিকা-সহ গোটা বিশ্বে কিছু বার্তা অবশ্যই নিয়ে এসেছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, সংখ্যাগুরুর স্বৈরতন্ত্রের জয়যাত্রাকে গণতান্ত্রিক সংহতি থমকে দিতে পারে। তাকে উচ্ছিন্ন করতেও পারে। সেই সঙ্গে এমন আশাও এই ঘটনা জাগায় যে, এখনও মানবতার এক বিশ্বময় আদান-প্রদানের মুক্তধারা বিদেশি-বিদ্বেষী, অভিবাসন-বিরোধী জাতীয়তাবাদকে অতিক্রম করে যেতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প-মাইক পেন্সকে হারিয়ে বাইডেন-কমলা হ্যারিসের বিজয় আমেরিকা-সহ গোটা বিশ্বে কিছু বার্তা অবশ্যই নিয়ে এসেছে।
আমেরিকার নির্বাচনের ফলাফলকে যতটা সংকীর্ণ বলে মনে হচ্ছে, বাস্তবে কিন্তু তা ততটা নয়। একটা দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় ৫০ লক্ষ ভোটের মার্জিন বা ৪ শতাংশের পার্থক্য স্পষ্ট ও নিশ্চিত বিজয়েরই সূচক। আমেরিকার বিদঘুটে এবং বাতিলযোগ্য ইলেক্টোরাল কলেজ ব্যবস্থাই এই ‘সংকীর্ণ বিজয়’-এর একটা দৃষ্টিবিভ্রম তৈরি করেছে। মিশিগান, উইসকনসিন এবং পেনসিলভেনিয়ারর মতো একদা শিল্পোন্নত ও বর্তমানে পিছিয়ে পড়া ‘রাস্ট-বেল্ট’ হিসেবে পরিচিত স্টেটগুলিতে যে ডেমোক্র্যাট ভোটাররা ২০১৬-এ নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তাঁরাই এ বার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেন। জর্জিয়া এবং অ্যারিজোনার মতো স্টেটে জন লিউইসের মতো মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা বা জন ম্যাককেনের মতো বীরের অপমানিত আত্মা যেন ট্রাম্পের ঔদ্ধত্যের সমুচিত জবাব দিল।
আরও পড়ুন: বাইডেন ক্যাবিনেটে আসছেন ১ বঙ্গসন্তান-সহ ২ ভারতীয় বংশোদ্ভূত
আটলান্টায় স্ট্যাসি অ্যাব্রামস আফ্রিকান-আমেরিকান ভোটদাতাদের এবং ফিনিক্স অঞ্চলে ট্রাম্পের অসংহত জাতিবিদ্বেষ এবং নিষ্ঠুর অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে তরুণ ল্যাটিনো ভোটকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। কেবল মাত্র ফ্লরিডার মায়ামি-ডেড অঞ্চলের কিউবান-আমেরিকানদের কাছে বাইডেন এবং হ্যারিসকে চরম বামপন্থী হিসবে তুলে ধরতে রিপাবলিকানরা সফল হয়েছিলেন। ট্রাম্পের মিছিলগুলির উপরে খোলামেলা ভাবে জাতিবিদ্বেষী ও লিঙ্গবৈষম্যমূলক বিষয়ে আক্রমণ কমলা হ্যারিসের ভাবমূর্তিকে এক অনন্য মর্যাদা দান করে। ভারতীয় ও জামাইকান বংশোদ্ভূত কমলা শিক্ষাদীক্ষায় এবং নিজের পছন্দে নিজেকে গড়ে তুলেছেন আফ্রিকান-আমেরিকান ঐতিহ্যে। কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ভোটের প্রায় ৯০ শতাংশ বাইডেন-হ্যারিস পেয়েছেন এই কারণেই। দেশের অভ্যন্তরের জাতি ও লিঙ্গবৈষম্যগত ইস্যুগুলিকে তাঁদের নির্বাচনী এজেন্ডায় তাঁরা স্থান দিয়েছিলেন। যদিও এটা সত্য যে, বাইডেন এবং হ্যারিস দু’জনেই তাঁদের শিকড়কে আয়ারল্যান্ড, ভারত ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে নিহিত দেখিয়েছেন, তবু এটা তাঁদের বিশ্বসংক্রান্ত ধারণারই পরিচায়ক হয়ে দাঁড়ায়। বাইডেনের ঈষৎ নরম স্লোগান ‘আমেরিকান কিনুন’ ট্রাম্পের ‘আমেরিকানই প্রথম’-এর চাইতে বহু দূরের ব্যাপার। ‘স্টেট ফরেন রিলেশন্স কমিটি’-র ভাইস প্রেসিডেন্টের পদে কাজ করে আসা বাইডেন যে বৃহত্তর বিশ্বের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ককে পুনর্বিন্যস্ত করতে পারেন, এমন একটা ধারণা গণমানসে তৈরি হয়ে যায়। এটা মনে হতে শুরু করে যে, বাইডেন প্রশাসনের প্রথম পদক্ষেপই হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে প্রত্যাবর্তন।
ট্রাম্পের এই পরাজয় কি অন্যান্য দেশে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হয়ে আসা কর্তৃত্ববাদী নেতাদের সম্পর্কে কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করছে?
ট্রাম্পের দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফেরার মতো বিপর্যয়কে এড়ানো গিয়েছে।
সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে অবস্থানরত সংখ্যাগুরুতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার প্রবণতা একটা লক্ষণীয় বিষয়। মোদী, এরডোগান, জনসন এবং বলসোনারোর মতো শাসকের তরফে ধর্মীয় বা জাতিভিত্তিক সংখ্যাগুরুত্বের অপপ্রয়োগ করে বিশ্বায়ন-বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী কন্ঠস্বর প্রকাশের ক্ষেত্রে ট্রাম্পকে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখা যায় না। সংখ্যালঘু-বিরোধী উদগ্র মনোবৃত্তিকে নাগরিকত্ব ও অবৈধ অনুপ্রবেশের মুখোশে ঢেকে প্রয়োগের ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী ট্রাম্পকেও টেক্কা দিতে পারেন। ২০১৪ সালে যখন আমি নির্বাচনী প্রচার করছি, তখন হতবাক হয়ে শুনেছিলাম, ফল প্রকাশ হলে মোদী সমস্ত ‘অবৈধ অভিবাসী’কে তাড়িয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত পার করে দেবেন। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব নিয়ে যে সংকট দেখা দিল, তার শিকড় ২০১৪-এর নির্বাচনী প্রচারের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। ট্রাম্প এই ভঙ্গিমা ২০১৬-তে গ্রহণ করেছিলেন। আর বরিস জনসন করেছিলেন তাঁর ব্রেক্সিট সংক্রান্ত প্রচারের সময়।
অনুপ্রবেশের মুখোশে ঢেকে প্রয়োগের ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদী ট্রাম্পকেও টেক্কা দিতে পারেন।
আরও পড়ুন: ২০৩০ সালে ব্রিটেনে নিষিদ্ধ পেট্রোল এবং ডিজেল গাড়ি, আজ ঘোষণা জনসনের
সাগরের ওপারে ট্রাম্পের পরাজয়ের প্রথম ধাক্কা হবে জনসনের ঘোর দক্ষিণপন্থী ব্রেক্সিটীয়-সরকারের পতন। ট্রাম্পের জমানার প্রথম দিকে স্টিভ ব্যানন যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, জনসনের ক্ষেত্রে সেই ভূমিকাই নিয়েছেন ডমিনিক কামিংস। ১০, ডাউনিং স্ট্রিট থেকে ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’ এবং ‘টেক ব্যাক কন্ট্রোল’-এর মতো স্লোগানের রূপকার কামিংসের ১০ ডাউনিং স্ট্রিট থেকে আসন্ন বিদায় জনসনের জমানার বাকি সময়টুকু সম্পর্কে কোনও ভাল আভাস দিচ্ছে না। আগামী নির্বাচনে কির স্টার্মারের নেতৃত্বাধীন লেবার দলের জিতে আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট। আবার মসনদে থেকে আইন লঙ্ঘনের ব্যাপারে ইংল্যান্ডের মূলধারার কনজারভেটিভরা আমেরিকার রিপাবলিকান সেনেটরদের চাইতে কম উৎসাহী। কিন্তু ভারতে বিরোধীপক্ষের কাছে মোদীকে সরানো অনেক কঠিন কাজ। খানিকটা এই কারণে যে, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মোদী দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছেন এবং বাকিটা এই কারণে যে, তাঁর বিরুদ্ধে একটা কার্যকরী কেন্দ্রীয় ফ্রন্ট গঠন করা শক্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যাই হোক, ট্রাম্পের পরাজয় অন্যান্য কর্তৃত্ববাদীদের কাছে কিছুটা অশনি সংকেত তো বটেই। তা তিনি হিউস্টন বা আমদাবাদ যেখান থেকেই তাঁর ধামা ধরুন না কেন।
সাগরের ওপারে ট্রাম্পের পরাজয়ের প্রথম ধাক্কা হবে জনসনের ঘোর দক্ষিণপন্থী ব্রেক্সিটীয়-সরকারের পতন।
ট্রাম্প বিদায় হলেও ট্রাম্পবাদের বিষাক্ত উত্তরাধিকারকে মোটেই ছোট করে দেখা উচিত হবে না। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ টিম স্নাইডার ‘বস্টন গ্লোব’ কাগজে প্রকাশিত তাঁর এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে দেখিয়েছেন যে, পরিবর্তনের কালেও ট্রাম্প যে সব গুজব ছড়াচ্ছেন বা আমেরিকান গণতন্ত্রের বৈধতাকে তাচ্ছিল্য করে যে সব উক্তি করে যাচ্ছেন, তাকে উপেক্ষা করলে চলবে না। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত বেঞ্জামিন হেট-এর ‘দ্য ডেথ অব ডেমোক্র্যাসি’ গ্রন্থের সমালোচনায় স্নাইডার লিখেছেন, ‘যখন দুরভিসন্ধিযুক্ত নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃত ভাবে তাদের দুর্বলতাগুলোকে প্রকাশ করে বসে, তখন বুঝতে হবে সংবিধান ভেঙেপড়ছে’।
স্নাইডারের দুশ্চিন্তা অমূলক নয়। যাই হোক, ২০ জানুয়ারি, ২০২১-এ হার মানতে অনিচ্ছুক এক রাজনীতিক রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে চ্যুত হবেন। সেই মুহূর্তে আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্বের প্রচারকর্তারা-সহ বিশ্বের অন্যত্র রাজনৈতিক অন্ধত্ব ও অর্থনৈতিক একদেশ দর্শিতার প্রচারক ট্রাম্প-পন্থী নেতৃবর্গ জব্বর ধাক্কা খাবেন। তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
(লেখক হার্ভার্ডের মাস্টারমশাই, ভারতের প্রাক্তন সাংসদ এবং নেতাজি পরিবারের সদস্য)