আহমেদ বদর ও মহম্মদ হাফিজ
বাক্স বাক্স ঘর। বাক্সের মধ্যে ঘর। শব্দগুলো ‘লিটল বক্সেস’ গানটার কথা মনে পড়ালেও এই বাক্সগুলো ঠিক সেই বাক্সের মতো নয়। সবার বাক্স ঠিক এক রকমও নয়। বরং বাক্সের অন্দরে এক একটা আলাদা গল্প। বাক্সের সামনে হেডফোন কানে নিয়ে দাঁড়ালে আমি-আপনি সেই গল্পটা জানতে পারব। আফগানিস্তান, কঙ্গো, সিরিয়া, ইরাক এবং সুদান থেকে আসা মানুষের রোজনামচা।
গল্প থেকে শুধু সহমর্মিতা খোঁজা নয়। গল্পগুলোর কাছে মানবিক ছোঁয়া নিয়ে পৌঁছতে চেয়েছেন সিরীয় মার্কিন নাগরিক মহম্মদ হাফিজ এবং ইরাকি মার্কিন আহমেদ বদর। ওঁদের পথ চলার শুরু বছর দুই আগে। আদতে সিরিয়ার যুবক মহম্মদ হাফিজ় পেশায় স্থপতি। আর আদতে ইরাকে জন্মানো তরুণ আহমেদ লেখেন আর সুন্দর বলেন। দু’জনে মিলে শুরু করেছেন, ‘আনপ্যাকড: রিফিউজি ব্যাগেজ।’ বাক্সের পরে বাক্সে (আসলে ছোট ছোট খোলা সুটকেস) মহম্মদ তুলে আনেন (ইনস্টলেশন) ঘরবাড়ি, প্রকৃতির সেই সব অংশ, যা যুদ্ধ অথবা সঙ্কটে দীর্ণ হয়ে গিয়েছে। প্রতি বাক্সের গল্প শোনাচ্ছেন এক জন। যাঁরা ওই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে আমেরিকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
গল্প জোগাড় করে সবটা জড়ো করেন আহমেদ। হেডফোনে সেই ব্যক্তির কণ্ঠে এগোয় গল্প। তার পরেই প্রদর্শনী হয় নানা গল্পের বাক্স নিয়ে। আহমেদ এখন কানেক্টিকাটের ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নিজে এক সময় ইরাক থেকে পা রেখেছিলেন আমেরিকায়। বয়সে বড় মহম্মদ ভয়েস মেসেজে জানালেন ওঁদের কাজের কথা। বললেন, ‘‘আহমেদ এখন আর নিজেকে শরণার্থী বলেন না। গ্রিন কার্ড পেয়ে গিয়েছেন।’’ আহমেদের জড়ো করা গল্প হেডফোনে কিছুটা জানার পরে আগ্রহীরা অনলাইনে তাঁদের কথা বিস্তারিত ভাবে শুনতে পারেন ‘আনপ্যাকড: রিফিউজি ব্যাগেজ’-এর পেজে গিয়ে।
এ ভাবেই সুটকেসে রাখা হারানো ঘরের গল্প। নিজস্ব চিত্র
দামাস্কাসে জন্মানো মহম্মদ বড় হয়ে উঠেছিলেন সৌদি আরবে। তার পরে আমেরিকায় পড়াশোনা। ‘পশ্চিম’ এবং ‘পূব’— দুই দুনিয়াকেই কাছ থেকে দেখার সুবাদে মহম্মদ তাঁর সৃষ্টিতে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তুলে আনেন অনায়াসে। তাঁদের প্রদর্শনী শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় নিজের ফেলে আসা ঘরে। ঘর হারানোর যন্ত্রণা যখন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাকে ভাগ করে নেওয়াটাই মানবিকতা, মনে করেন মহম্মদরা।
কোন ভাবনা থেকে এই কাজ শুরু করলেন? মহম্মদের কথায়, ‘‘আমার পরিবারেরই কয়েক জনকে হঠাৎ এক দিন শরণার্থী হয়ে যেতে হয়েছিল পরিস্থিতির ফেরে। ওঁদের গল্পগুলো এত কাছ থেকে দেখা যে, রোম্যান্টিকতা নয়, মানবিক ভাবে দেখাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।’’
এত দেশের শরণার্থীর কথা ভাবছেন, মেক্সিকো সীমান্ত নিয়ে কোনও ভাবনা আছে? ‘‘এই মুহূর্তে না হলেও ভবিষ্যতে নিশ্চয় করব। শুধু মেক্সিকো কেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শরণার্থী, অর্থনৈতিক কারণে যারা ঘর হারায়, তাদের কথাও ভাবব,’’ বললেন স্থপতি।
আহমেদ বদর আরও ছোট বয়সে আমেরিকায় এসেছিলেন। তখন কোনও হেনস্থার মুখে পড়েননি? ‘‘সে ভাবে হেনস্থা বলা না গেলেও একটা বিদেশি ছোট ছেলের পক্ষে আমেরিকায় মানিয়ে নেওয়া মুখের কথা নয়। বিশেষ করে যখন শরণার্থীর তকমা সেঁটে দেওয়া হয়,’’ আহমেদের হয়ে বলেন সতীর্থ মহম্মদই। আর নিজের কথা বলতে গিয়ে মহম্মদ বলেছেন, ‘‘২০০৩ সালে আমেরিকায় স্থাপত্যবিদ্যা পড়তে আসা। ছ’বছর পড়ার পরে কাজ শুরু। আমেরিকায় আছি ১৬-১৭ বছর। আমি এখন সিরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। আমার অনেক আত্মীয়ই এখনও গ্রিন কার্ড পাননি। তাঁদের জন্য এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। যত দিন নাগরিকত্ব পাইনি, তত দিন আমারও চাপ গিয়েছে। আট বছর বাড়ি যেতে পারিনি। যুদ্ধ-ধ্বস্ত দেশ থেকে এলে পাসপোর্ট পাওয়াটাও আর একটা লড়াই।’’
এর পরে কী ভাবছেন? ‘‘এই কথোপকথনটা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। শুধু কয়েকটা দেশ নয়। অসংখ্য সংস্কৃতি কী ভাবে মিলেমিশে যেতে পারে, তা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। আমরা বিদেশি-ভীতি আর বিভাজনের রাজনীতির মধ্যে বাস করছি। শুধু আমেরিকা নয়, এই সমস্যা গোটা বিশ্বের। তাই আমার বিশ্বাস, শিল্পীরা সেতুবন্ধনের কাজটা করতে পারেন।’’ বিশ্বের এত জায়গা ঘুরে প্রদর্শনী করেন, ভারতে আসবেন? ‘‘ভারতে আসার খুবই আগ্রহ রয়েছে। দেখি, কবে হয়,’’ বললেন মহম্মদ।