আতঙ্কের দেশে আনন্দবাজার

গাড়ির মিছিল আর ধস ঠেলে তিন ঘণ্টায় দু’কিলোমিটার

পাহাড়ের কোলে অখ্যাত জনপদের গায়ে পুঁচকে সাঁকোটাই লাইফ-লাইন। টানা দু’দিন প্রকৃতির যাবতীয় অভিঘাত সহ্য করে যে এখনও টিকে আছে। আর টিকে আছে বলেই কাঠমান্ডু আর পোখরা থেকে কার্যত প্রাণ হাতে করে পথে নামা জনস্রোতও টিকে আছে। ত্রিশূলী নদীর উপরে সিমেন্টের সাঁকো পেরিয়েই চিতওয়ান জেলার কিনারে গঞ্জ-শহর মুগলিং।

Advertisement

ঋজু বসু

মুগলিং (নেপাল) শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:০৮
Share:

কাঠমান্ডুর পথে মুগলিং-এর কাছে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। সোমবার দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

পাহাড়ের কোলে অখ্যাত জনপদের গায়ে পুঁচকে সাঁকোটাই লাইফ-লাইন।

Advertisement

টানা দু’দিন প্রকৃতির যাবতীয় অভিঘাত সহ্য করে যে এখনও টিকে আছে। আর টিকে আছে বলেই কাঠমান্ডু আর পোখরা থেকে কার্যত প্রাণ হাতে করে পথে নামা জনস্রোতও টিকে আছে।

ত্রিশূলী নদীর উপরে সিমেন্টের সাঁকো পেরিয়েই চিতওয়ান জেলার কিনারে গঞ্জ-শহর মুগলিং। ধসের মধ্যে আটকে থাকা গাড়ির স্রোতকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন নেপালি পুলিশবাহিনীর সেপাইরা। সুসময়ে পোখরার পর্যটকরা এই মুগলিং-এ নৌবিহারের জন্য ভিড় জমিয়ে থাকেন। গা ঘেঁষে দু’দিকে বেঁকে গিয়েছে পাহাড়ি রাস্তা। এক দিকে কাঠমান্ডু, অন্য দিকে পোখরা। নেপালের ভাগ্যরেখা এখন এই রকম কয়েকটি ছোট ছোট লোকালয়কে আঁকড়ে ধরেই মাথা তোলার চেষ্টা করছে।

Advertisement

কাঠমান্ডু বা পোখরা যাওয়ার মূল রাস্তাগুলো এখন বেশির ভাগই বন্ধ। বিহারের রকসৌল সীমান্ত দিয়ে নেপালে ঢোকার রুটটা শুধু খোলা আছে। সরু পাহাড়ি রাস্তা। তারই মধ্যে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে নেপালের দিকে দৌড়চ্ছে সারি সারি ট্রাক। আত্মীয়-পরিজনের খবর নিতে রকসৌলের দিক থেকে নেপালে ঢোকার চেষ্টা করছেন শয়ে শয়ে মানুষ। আবার নেপাল থেকে প্রাণের ভয়ে সমতলে নেমে আসছে উদভ্রান্ত জনতা। রাস্তার অবস্থা দমছুট। তার মধ্যেই পাহাড় থেকে ছিটকে আসছে পাথর।

সোমবার সন্ধেয় মুগলিং পৌঁছে এখানেও ফের মৃদু কম্পনের খবর কানে এল! শুনলাম, যে পথে এত ক্ষণ আটকে থেকেছি, রাতেই সেই পাহাড় ভাঙার তোড়জোড় শুরু হবে। জনতার ভিড়ে, হোটেলে-সাইবার কাফেতে-চায়ের দোকানে সরগরম মুগলিং এর মধ্যেই দাঁতে দাঁত চিপে দুর্বিপাকের সঙ্গে যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে।

২৪ কিলোমিটার দূরে নেপালের সাবেক জমানার রাজা পৃথিবীনারায়ণ শাহের স্মৃতিজড়িত গোর্খা নগরী ভূমিকম্পের ঝাপ্টায় বিধ্বস্ত। বারপাকের মতো একটি জনপদ কার্যত মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। নেপালের বীরগঞ্জে ঢুকে বহু সাধ্যসাধনা করে স্থানীয় চালকদের পটিয়ে এ দিন সকালে গোর্খা যাব বলেই পথে নেমেছিলাম। কাঠমান্ডু ও পোখরার মধ্যবর্তী বিন্দু মুগলিং পৌঁছে চালক অন্ধকারে আর এক পা-ও এগোতে রাজি হলেন না। এমনিতে বীরগঞ্জ থেকে মুগলিং পৌঁছতে বড়জোর চার ঘণ্টা লাগার কথা। ধসের সৌজন্যে প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টা কাবার হয়ে গেল। মুগলিং-এর মোটে দু’কিলোমিটার আগে কালীখোলার পাহাড়ি ঘাঁটি পেরোতেই সময় লাগল ঝাড়া তিন ঘণ্টা।

রকসৌল থেকে হেটোরা অবধি আসার পরে সরাসরি কাঠমান্ডুর দিকে না-গিয়ে ভরতপুর-নারায়ণগড় হয়ে মুগলিং-এর দিকে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে হয়েছিল। দুর্গতদের ত্রাণকাজে পথে নামা সশস্ত্র সীমা বলের জওয়ানরাই বলছিলেন, হেটোরা থেকে উপরের দিকে সরাসরি কাঠমান্ডুর রাস্তা দূরত্বে ৯০ কিলোমিটার মতো কম হলেও ওই দিকে যাওয়াটা হঠকারী হবে। বিকেলে ‘নিরাপদ’ রাস্তায় ধসের মাঝে আটকা পড়ে সেই জওয়ানদের চোখেমুখেও উদ্বেগের ছায়া পড়ল।

মুগলিং-এর সাঁকোর অনতি দূরে ধসের ধোঁয়ার মধ্যে গাড়ি নিয়ে যেতে যেতে চালক রাজেশ লামা তবু বারবার অভয় দিলেন, ‘‘একদম ডান দিকে পাহাড়ের দিকে তাকাবেন না। আমি ঠিক বেরিয়ে যাব!’’ উল্টো দিকে যানজটে আটকে থাকা কাঠমান্ডু বা পোখরা থেকে বিহার-সীমান্তমুখী বাস থেকেও তখন পিলপিল করে নামছে আতঙ্কিত জনতা। ধসের ধোঁয়া-ঢাকা অংশটুকু যাতে ছুট্টে পার হয়ে যাওয়া যায়। কাঠমান্ডু থেকে সাইকেল চালিয়ে নামতে থাকা বিহারি মজুর প্রমোদ লোহারই হোক বা বিরাটনগরের দিকে যাওয়া কাঠমান্ডুর কলেজশিক্ষক রমেশ ছেত্রী বা সদ্য বারাণসীতে বিশ্বনাথ দর্শন সেরে আসা আপ্রামপার গুরুঙ্গ— সোমবার বিকেলে সবার সঙ্গেই এই রাস্তাতেই দেখা হয়ে গেল। লন্ডনপ্রবাসী নেপালি যুবা আপ্রামপার। পোখরায় মহাদেব মন্দিরের আখড়ার বাবা সদাশিব, চেনা পণ্ডিতজি থেকে শুরু করে প্রৌঢ়া মা— সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে কাশী-ইলাহাবাদে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। দেশের দুর্দশার খবর পেয়ে পুণ্যার্জন অসমাপ্ত রেখেই ফিরে আসতে হয়েছে।

শিলিগুড়ির কাছে কাঁকরভিটা থেকে কাঠমান্ডুতে বাড়ি ফেরার জন্যে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ভানু শর্মাও এই পথই ধরেছেন। রবিবার রাত পর্যন্ত নাগাড়ে ‘আফটারশক’-এর ধাক্কায় মাঝপথে নারায়ণগড়ে এক রাত কাটিয়েছেন। ‘‘ভেঙেই পড়ুক আর আস্তই থাকুক, বাড়ি তো বাড়িই,’’ বলতে বলতে ভানুবাবু এ দিন বিকেলে ধসের আতঙ্ক মাথায় নিয়েই পরিবারসুদ্ধ গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসেছেন। গোর্খার পথে মুগলিং-অভিযানের পথে পাহাড়ি পথের অনন্ত যানজটে খাবি খেতে খেতে এই সব চরিত্রের মুখোমুখি হওয়া গেল।

জঙ্গল সাফারির জন্য বিখ্যাত চিতওয়ান জাতীয় পার্কের কাছে ভরতপুর, নারায়ণগড় পর্যন্ত পার হওয়ার পরেই মালুম হল, পুরোদস্তুর ভূমিকম্পের রাজত্বে ঢুকে পড়েছি। ভূমিকম্পের ধাক্কায় কী ভাবে দুলতে হয়েছে দু’দিন, সেই ফিরিস্তি জনে-জনে শুনিয়েছেন এত ক্ষণ! এ বার সরু পাহাড়ি রাস্তায় যানজট বুঝিয়ে দিল, এখন প্রতি পদক্ষেপেই সতর্কতা আবশ্যক। মুগলিং-এর কিলোমিটার দশেক দূর থেকেই কানে এল, পাহাড়ের গা থেকে পাথর খসে পড়ছে। সেই জন্যে ধাপে-ধাপে দু’টি-তিনটি করে গাড়ি ছাড়ছে। ‘‘ধুর, ধুর পাহাড় খসে পড়ছে আর পাগলের দল ওই দিকে যাচ্ছে,’’ বলতে বলতে উল্টো দিক ধরে সাঁ-সাঁ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বিহারের বেতিয়ার গাড়িচালক ইসা মহম্মদ। একটি বিয়ে উপলক্ষে কুটুমদের ফিরিয়ে আনতে কাঠমান্ডু যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। খবর পেয়েছেন, সে বাড়িটাই নাকি এখন ধরাশায়ী!

বাস্তবিক কাঠমান্ডু যাওয়ার সহজতম রাস্তাটা এখন কার্যত অগম্য হয়ে পড়ায় যত চাপ এই পথটুকুর ওপরেই আছড়ে পড়েছে। সকালে হাওড়া থেকে রকসৌল স্টেশনে নামার পরই দেখা হয়েছিল কাঠমান্ডু ফেরত সুশান্ত চক্রবর্তীর সঙ্গে। কাঁকুড়গাছির বাসিন্দা বলেছিলেন, বউ-মেয়েদের নিয়ে কী ভাবে একটা ছোট বাসে কাঠমান্ডু থেকে বীরগঞ্জ হয়ে রকসৌলে ফিরেছেন। ‘‘ভাঙাচোরা রাস্তা, তায় বৃষ্টি! বারবারই ভয়ে চোখ বুজে ফেলছিলাম। কী ভাবে যে পৌঁছলাম, আমরাই জানি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement