(বাঁ দিক থেকে) ব্যারি বারিস, কিপ থর্ন ও রাইনার ওয়েইস। ছবি: রয়টার্স।
নাহ্, কোনও চমক নেই। এ বছরের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে। পাচ্ছেন তিন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী রাইনার ওয়েইস, ব্যারি বারিস এবং কিপ থর্ন। ওঁরা পুরস্কৃত হচ্ছেন মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তের জন্য।
বহু-প্রতীক্ষিত ঈশ্বরকণা শনাক্ত হওয়ার পরে সবাই যেমন ভেবেছিলেন এ জন্য নোবেল তো কেবল সময়ের অপেক্ষা। আর বাস্তবেও হয়েছিল তা-ই। এ-ও যেন তেমনই ব্যাপার। কণা-পদার্থবিদ্যায় ঈশ্বরকণা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, জ্যোতির্বিজ্ঞানে মহাকর্ষ তরঙ্গও তেমনই মূল্যবান।
১৯১৬ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন-আবিষ্কৃত ‘জেনারেল রিলেটিভিটি’ তত্ত্বে ইঙ্গিত মিলেছিল মহাকর্ষ তরঙ্গের। ১০০ বছর পরে ২০১৬ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি যখন ঘোষণা করা হয় যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করেছেন সেই তরঙ্গ, তখন থেকে সবাই জানতেন এ সাফল্য নোবেল শিরোপা পাবেই। কারণ, ওই কৃতিত্ব জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণায় নতুন যুগ শুরু করেছে। যে সাফল্য বিজ্ঞানচর্চায় আনে নতুন যুগ, তাকে সম্মান না জানালে বিজ্ঞানই বাতিল হয়ে যায় যে!
কোন সে কৃতিত্ব, যাতে জ্যোতির্বিজ্ঞান পেয়েছে নতুন পথের দিশা? নিউটন বলেছিলেন, ব্রহ্মাণ্ডের দুই বস্তু সব সময় একে অন্যকে কাছে টানে। ওটাই নাকি মহাকর্ষ। নিউটনের ব্যাখ্যায় ওই মহাকর্ষের কারণেই নাকি পৃথিবী সূর্যের চারপাশে আর চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। জেনারেল রিলেটিভিটি-তে আইনস্টাইন বললেন, মহাকর্ষ দুই বস্তুর মধ্যে টানাটানি নয়, অন্য কিছু। এক বস্তুর চার পাশে শূন্যস্থান ওই বস্তুর উপস্থিতির কারণে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। দ্বিতীয় বস্তু যখন প্রথম বস্তুর কাছাকাছি আসে, তখন ওই দোমড়ানো শূন্যস্থানের মধ্যে দিয়ে চলতে গিয়ে তার পথ যায় বেঁকে।
দুটো ভারী বস্তু— যেমন দুটো ব্ল্যাক হোল— যখন একটা আর একটাকে চক্কর কাটে, কিংবা একটা আর একটার সঙ্গে মিশে যায়, তখন শূন্যস্থানে (যা দুমড়ে গিয়েছে আগেভাগেই) এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। শূন্যস্থানে সাংঘাতিক কাঁপন এবং সেই কাঁপনের দশ দিকে তরঙ্গাকারে বিস্তার। ওইটেই হল মহাকর্ষ তরঙ্গ। তরঙ্গ মানে? শূন্যস্থান এক বার ছোট, এক বার বড়। এই বাড়া-কমাই তরঙ্গাকারে ছড়ায়। নিউটনের গ্র্যাভিটি তত্ত্বে মহাকর্ষ তরঙ্গ নেই। আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি-তে তা আছে। মহাকর্ষ তরঙ্গ, সুতরাং, আইনস্টাইনকে সামনে এনে নিউটনকে পেছনে ফেলে দেয়।
গত বছর ১১ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মহাশূন্যে ও রকম দুটো ব্ল্যাক হোল মিশে যাওয়ায় যে মহাকর্ষ তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল, তা পৃথিবীতে বসে তাঁরা শনাক্ত করেছেন। শনাক্ত করেছে যে যন্ত্র তাঁর নাম লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্রাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজার্ভেটরি (লাইগো)। দু’টো ব্ল্যাক হোল মিশে এক হয়েছিল ১৩০ কোটি বছর আগে। অত কাল আগে ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে ঘটেছিল যে ধুন্ধুমার কাণ্ডটি, তার রেশ পৃথিবীতে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ১৩০ কোটি বছর। রেশ যে অতি ক্ষীণ, তা বলাই বাহুল্য। অত ক্ষীণ রেশ শনাক্ত করতে চাই অতি সংবেদনশীল যন্ত্র। লাইগো সে রকমই এক যন্ত্র।
কৃতিত্বের জন্য ওয়েইস পাচ্ছেন ৯০ লক্ষ সুইডিশ ক্রোনর-এর অর্ধেকটা। আর বারিস এবং থর্ন পাচ্ছেন ওই অর্থের এক-চতুর্থাংশ করে। যদিও আজ পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মনে পড়ছে আর এক জনের নাম। তিনি রোনাল্ড ড্রেভর। পুরস্কৃত ওই তিন বিজ্ঞানীর সঙ্গে তিনিও অনেক দিন কাজ করেছিলেন সমান তালে। এ বছর মার্চ মাসে প্রয়াত হন ড্রেভর।
ওয়েইস এখন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে এমিরেটাস প্রফেসর। বারিস এমিরেটাস প্রফেসর ক্যালিফোর্নিয়ার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-তে। আর থর্ন অধ্যাপনা করেন ওখানেই। নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তে বিচক্ষণতা স্পষ্ট। ওই ত্রয়ীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব নিশ্চয়ই ওয়েইসের। লাইগো কী ভাবে গড়া হবে, শুরুতে তার অর্থ জোগাড় এবং শেষ পর্যন্ত অতি সংবেদনশীল যন্ত্রটি বানানো পর্যন্ত— সবটাই করেছেন তিনি। বারিস ওই গবেষণা প্রকল্পের হাল ধরেছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। ১৯৯৪ সালে, যখন তিনি অধিকর্তা হিসেবে যোগ দেন লাইগো প্রকল্পে, তখন অর্থ সাহায্যের অভাবে প্রকল্পটি প্রায় বন্ধ হবার জোগাড়। আর থর্ন? তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। মহাকর্ষ তরঙ্গ তৈরি হলে তা কী চেহারায় ধরা দেবে, সেটা বাতলেছেন এই বিজ্ঞানী।
মহাকর্ষ তরঙ্গের মাধ্যমে দূর-দূরান্তের ঘটনা এখন নতুন চেহারায় ধরা দিচ্ছে। এই কয়েক দিন আগেও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছেন, গত ১৪ অগস্ট মহাশূন্যে দু’টো ব্ল্যাক হোলের মিশে যাওয়ার ঘটনা ধরা পড়েছে ওই তরঙ্গ শনাক্ত করে।
মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তের সাফল্যে তিন বিজ্ঞানীকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার ঘটনায় উৎসাহিত হয়েছেন ভারতীয় গবেষকরাও। এ দেশে যে তৈরি হচ্ছে লাইগো-ইন্ডিয়া নামে তরঙ্গ শনাক্তকরণে আর এক যন্ত্র। ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর যে তরঙ্গ শনাক্ত হয়েছিল, তাতে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও। ১৯৭০ সালে ভারতীয় বিজ্ঞানী সি ভি বিশ্বেশ্বরা দুই ব্ল্যাক হোল মিশ্রণের যে প্রক্রিয়া বাতলেছিলেন, তা সত্য বলে প্রমাণিত। লাইগো-ইন্ডিয়া তৈরি হলে, তরঙ্গ শনাক্তকরণে যোগ দেবেন অনেক তরুণ ভারতীয় গবেষক।