কাবুলের রাস্তায় তালিবরা। ছবি রয়টার্স।
‘‘সাবিনা, আর ইউ সেফ?’’
১৬ অগস্ট সকালে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজটা পাঠিয়েছিলাম। আধ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সেটা ‘আনসিন’। ভাবছি, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়বে না তো! কলকাতার মাটিতে বসে ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ গোছের স্তোকবাক্যের কি কোনও মানে আছে! এই সব সাত-পাঁচ মাথায় আসছে। যখন ভাবছি, মেসেজটা ডিলিট করে দেব, ঠিক তখনই হঠাৎ নীল দাগ পড়ল হোয়াটসঅ্যাপে। একটা সুতো একেবারে ছিঁড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে যেন একটু হালকা হল টান। ‘সাবিনা টাইপিং...’।
কোনও সুখবরের আশা করে মেসেজ পাঠাইনি। সাবিনা ভাল নেই, থাকার কথাও না। কয়েক সেকেন্ডেই ওর উত্তরটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল, ‘‘ভাল নেই। ঘরবন্দি। সবার মধ্যেই ভয়, অশান্তি। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমরা আবার শূন্যে পৌঁছে গেলাম। আমাদের দেশের নাগরিক আবার পরিচয়হীন হয়ে গেল। সবাই হতাশ। সবার মনোবল ভেঙে গিয়েছে।’’
সাবিনা বারাকজ়াই। ২০১৮ সালে কাবুলে জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়ক একটা সেমিনারে ওর সঙ্গে আলাপ। সাবিনা নিজে পরিবেশ বিষয়ক একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পরিচালক। বছর তেত্রিশের স্মার্ট, ঝকঝকে মহিলা। চোখে হাজারো স্বপ্ন আর দেশের হয়ে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তনের উপরে কাজ করার অদম্য স্পৃহা। হিজাব পরা, সদা হাস্যময়ী এক আফগান মেয়ে।
পরিবেশ নিয়ে গবেষণা এবং পরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ক কাজ করার সুবাদে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশই আমার বিচরণভূমি। কাজের জন্য আফগানিস্তানেও যেতে হয়েছে বার বার। প্রথম যাই ২০১৮-র জানুয়ারিতে। স্বাভাবিক ভাবেই ভিতরে একটা ভয় কাজ করছিল। সফরসঙ্গীরা প্রত্যেকেই পুরুষ।
অভিবাসন কাউন্টারে প্রত্যেক বারই এক প্রশ্ন শুনতে হয়, ‘‘আপনি আফগানিস্তান যাচ্ছেন? কেন? সাবধানে থাকবেন।’’ প্রথম বার মনে আছে, বিমানবন্দর থেকেই খুব কড়া নিরাপত্তায় আমরা হোটেলে পৌঁছেছিলাম। হোটেলটা ভারতীয় দূতাবাসের কাছেই। জানতে পারি, তিন মাস আগে হোটেলের সামনে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল। রাত হয়ে যাওয়ায় এবং আশেপাশের দোকানপাট বন্ধ থাকায় সে দিন বিশেষ জনমানব দেখিনি। সহকর্মীরা বললেন, ‘‘ঘর থেকে একা বেরিয়ো না, দরকার হলে আমাদের বোলো।’’
পরের দিন হিজাব পরে মিটিংয়ে গেলাম। অবাক কাণ্ড— অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ মহিলা। মনের মধ্যে একটা চোরা আনন্দ খেলে গেল! বাইরে যখন বেরোলাম, দেখলাম রাস্তায় ছোট-বড় মেয়ের দল স্কুলে যাচ্ছে, দোকানদারি করছেন মহিলারা, কেউ বা ব্যস্ত হয়ে অফিস যাচ্ছেন। অনেক মহিলা পরিবেশবিদের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তাঁরা নাগরিক সমাজের সঙ্গে যুক্ত। অবাক লাগছিল, জঙ্গি হানায় বিধ্বস্ত এই দেশে হয়তো পরিবেশ সচেতনতার বিষয়টি অগ্রাধিকারের তালিকায় অনেক নীচের দিকে থাকতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। দেখলাম যুবসমাজ ও মহিলাদের তাগিদে উন্নয়নের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আফগানিস্তানে অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে পরিবেশ সচেতনতা।
১৫ অগস্ট যখন জানতে পারলাম কাবুল তালিবানের দখলে, চেষ্টা করছিলাম কাবুলে আমার কাজের জগতের মহিলা সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে। সে দিন যোগাযোগ করতে পারিনি। পরের দিন যোগাযোগ হল ২৩ বছরের মহিলা সাংবাদিকের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সঙ্গে। সে বলল, ‘‘মা-বোনেদের নিয়ে কাবুলের বাইরে দেশের বাড়িতে চলে এসেছি লুকিয়ে থাকার জন্য। তালিবান যদি কিছু করে, তা হলে আত্মহত্যা করব।’’
গলার স্বরের দৃঢ়তা দেখে ভয় পেলাম। কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। শুনলাম ৬৫ বছরের এক প্রাক্তন মন্ত্রী, যিনি তালিবানের সাথে শান্তি-চুক্তিতে যুক্ত ছিলেন, তিনিও এখন গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। সুযোগ খুঁজছেন আলবেনিয়ায় পালানোর। সোলেমান নামে স্থানীয় এক যুব নেতা গত কাল বললেন, ‘‘মা-বৌ-মেয়েদের পাঠিয়ে দিলাম একটু নিরাপদ জায়গায়। জানি না কত দিন বাঁচব। মেয়ে দু’টোর আর স্কুলে যাওয়া হবে না। হয়তো ওদের ঠিকঠাক রাখতে গেলে দু’এক বছরের মধ্যে বিয়ে দিতে হবে। বোনটা কানাডাতে রয়েছে, বারবার ফোনে কান্নাকাটি করছে। বলে দিলাম, কোনও দিন ও যেন আর দেশে না ফেরে।’’ শুনতে শুনতে চোখটা জ্বালা করছিল। গলাটা সামলে নিয়ে বললাম ‘‘দেখো, হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ সে-ও একটা ‘‘হুম...’ বলল। কী বলতে চাইল, বুঝলাম না। হয়তো বুঝতে চাইলামও না।
আফগানিস্তানে যে সূর্যটা উঠছিল, ভোর হচ্ছিল, ঝপ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। আফগানিস্তান আবার কবে সূর্যোদয় দেখা যাবে জানি না। এখন একটাই প্রার্থনা, সাবিনারা যেন সুরক্ষিত থাকে। পরিবেশ নিয়ে ভাবনা আপাতত তোলা থাক।
(লেখক পরিবেশকর্মী)