Bangladesh Unrest

আদিবাসীদের ‘সর্বাত্মক অবরোধে’ স্তব্ধ পার্বত্য চট্টগ্রাম, হঠাৎ হিংসা কেন বাংলাদেশের পাহাড়ে?

চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি-সহ বিভিন্ন এলাকার সমাবেশ করে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের ডাক দিয়েছে পাহাড়ে বসবাসকারী চাকমা-সহ বিভিন্ন অমুসলিম জনজাতি সংগঠনগুলি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৫৪
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সেনাবাহিনীর গুলির এবং মুসলিম কট্টরপন্থীদের হামলার প্রতিবাদে আদিবাসী সংগঠন ইউনাইটেড পিপল্‌স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর ডাকা সর্বাত্মক অবরোধের জেরে শনিবার স্তব্ধ হয়ে গেল বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম (চিটাগং হিল ট্র্যাক্ট বা সিএইচটি) এলাকা। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দারবন এবং রাঙামাটিতে ‘সিএইচটি ব্লকেড’ নামে ৭২ ঘণ্টার সড়ক ও নৌপথ অবরোধের এই কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছে, ‘বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’ নামের সংগঠনটি।

Advertisement

আদি বাসিন্দা চাকমা এবং অন্যান্য জনজাতি গোষ্ঠীর উপর গত ৭২ ঘণ্টা ঘরে ধারাবাহিক হামলা চলছে। খুন হয়েছেন অন্তত ১০ জন অমুসলিম। পোড়ানো হয়েছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, কুকি, ব্রু এবং অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের হাজারেরও বেশি বাড়িঘর, ধর্মস্থান, দোকান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সেনা, বিজিপি এবং র‌্যাব বাহিনীও বিচ্ছিন্নতাবাদী দমনের অছিলায় অমুসলিমদের উপর নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ। অন্য দিকে, বাংলাদেশ সেনা বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়িতে গুলি চালিয়ে তিন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমাকে খুনের ‘ব্যাখ্যা’ দিয়ে বলেছে, ‘‘ইউপিডিএফ অশান্তিতে প্ররোচনা দিচ্ছে। আত্মরক্ষার্থেই গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে সেনা।’’

এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি-সহ বিভিন্ন এলাকার সমাবেশ করে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের ডাক দিয়েছে পাহাড়ে বসবাসকারী চাকমা-সহ বিভিন্ন অমুসলিম জনজাতি সংগঠনগুলি। তাঁদের ‘আদিবাসী’ তকমা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সক্রিয় হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে ‘মার্চ ফর আইডেন্টিটি’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে পাহাড়ি অমুসলিমেরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঢাকার সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৪৪ ধারা জারি করেছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে লেখা হয়েছে— ‘‘৭২ ঘণ্টার এই অবরোধের শুরুতেই তিন জেলায় দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলছে না। এ কারণে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।’’

Advertisement

সূত্রের খবর, বুধবার খাগড়াছড়ি নোয়াপাড়া এলাকায় মহম্মদ মামুন নামে এক দুষ্কৃতী মোটরসাইকেল চুরি করে পালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার মুখে পড়েন। আহত অবস্থায় ধরা পড়ার পরে তাঁকে মারধর করা হয়। পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান। স্থানীয় দিঘিনালা সরকারি কলেজের বিএনপি এবং জামাতে ইসলামির সমর্থক ছাত্রেরা অভিযোগ তোলে মানুনকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। এরই জেরে হাঙ্গমা শুরু হয়। অভিযোগ, কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে গিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের বোয়ালপাড়া বাজার, লারমা স্কোয়ারের মতো এলাকায় অমুসলিম আদিবাসীদের বাড়িঘর, দোকান, ধর্মস্থান ভেঙে আগুন ধরানো হয়। পিটিয়ে মারা হয় কয়েক জনকে।

এর প্রতিবাদে রাঙামাটিতে জনজাতি ছাত্রেরা মিছিল বার করলে শুরু হয় নিরাপত্তা বাহিনী এবং জামাত আশ্রিত দুষ্কৃতীদের হামলা। অভিযোগ, সেখানেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এমনকি, চট্টগ্রামের সমতল এলাকাতেও বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টানদের উপর হামলার ঘটনা ঘটছে। পরিস্থিতি সামলাতে সেনা মোতায়েন করা হলেও তাতে অমুসলিম জনজাতিদের মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। পরিকল্পিত ভাবে অন্তর্বর্তী সরকার হিংসা ছড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে জনবিন্যাসের চরিত্র বদলে দিতে চাইছে বলে অভিযোগ। জনজাতিদের অবরোধের মধ্যেই শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফ্‌টেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মহম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছে।

বস্তুত, প্রায় চার দশক আগেই ওই অভিযোগ উঠেছিল বাংলাদেশে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনবিন্যাস বদলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের আমলে প্রায় ৫০ হাজার সমতলের মানুষকে পাহাড়ে বসতি গড়ে দেওয়া হয়। ‘সেটলার’ নামে পরিচিত সেই জনগোষ্ঠী আজ সংখ্যায় বহু গুণ বেড়ে চাকমা ও অন্য জনজাতিদের অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। বান্দারবনে মুসলিম জনসংখ্যা ইতিমধ্যেই ৫২ শতাংশ পেরিয়ে গিয়েছে। খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটির পাহাড়েও দ্রুত মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে। নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ছেন চাকমা, ব্রু, কুকি, মারমা, ত্রিপুরা জনজাতিরা। আর সেখান থেকেই সংঘাতের সূত্রপাত।

আদিবাসীদের অভিযোগ, হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই বাইরে থেকে এসে বসতি গড়া লোকেরা চাকমাদের উপরে হামলা, জমি দখল এবং দেশছাড়ার জন্য হুমকি দিতে শুরু করেছে। হামলাকারীদের প্রত্যক্ষ মদত দিচ্ছে বাংলাদেশ সেনা। কয়েকশো বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর বাস। ভারত এবং মায়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের অঞ্চলগুলি নিয়ে কুকি স্বশাসিত অঞ্চলের দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরেই লড়াই চালাচ্ছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। সম্প্রতি কুকি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের নামে নতুন করে অভিযান শুরু করেছে বাংলাদেশ সেনা এবং র‌্যাব। জঙ্গি দমন অভিযানের নামে সাধারণ কুকিদের উপর অত্যাচারের অভিযোগও উঠেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement