মোদী-শরিফ বৈঠক। শুক্রবার লাহৌরে। — ফাইল চিত্র।
চলতি মাসের গোড়ার দিক। আড্ডা বসেছে লাহৌরে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বাসভবনে। নওয়াজ ছাড়াও রয়েছেন তাঁর মা, স্ত্রী, মেয়ে নাতি-নাতনিরা। আরও এক জন রয়েছেন। তিনি— ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। ‘হার্ট অব এশিয়া’ সম্মেলনের ফাঁকে যিনি আতিথ্য গ্রহণ করেছেন নওয়াজের।
উর্দুতে কথা বলছিলেন সুষমা। নওয়াজের মা বলেই ফেললেন, ‘‘এমন সুন্দর উর্দু শিখলে কী করে?’’ সুষমা বললেন, ‘‘ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে অনেক সময়ই উর্দুতে কথা বলতাম। বাবা উর্দু পড়তে, লিখতে আর বলতে পারতেন। উর্দু তো ভারতীয় ভাষাই।’’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পাঠানো উপহারটা নওয়াজের হাতে তুলে দিলেন সুষমা। একটা দারুণ কাশ্মীরী শাল। সঙ্গে সঙ্গে সেই শাল গায়ে জড়িয়ে পুরনো বলিউডি ছবির গান গুনগুন করে উঠলেন পাক প্রধানমন্ত্রী।
তত ক্ষণে শুরু ফোটোসেশন। সুষমাকে জড়িয়ে ছবি তুললেন নাতি-নাতনিরা। তার পর ভূরিভোজ। হরিয়ানার মেয়ে সুষমার জন্য হাজির সর্ষের শাক, বেগুনের ভর্তা, পনির থেকে শুরু করে লোভনীয় সব নিরামিষ পদ (মোদীর মতো তাঁর বিদেশমন্ত্রীও নিরামিষাশী)। দেশভাগের আগে অমৃতসরের বাসিন্দা ছিল শরিফ পরিবার। নওয়াজের মা এ বার পঞ্জাবি ভাষায় বলে ওঠেন, ‘‘পুত্তর নরেন মোদীকে এক বার আসতে বোলো এই শহরে। ওকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াব।’’ সুষমাও পত্রপাঠ উর্দু ছেড়ে কথা শুরু করেন শুরু করেন চোস্ত পঞ্জাবিতে। এ বার চমকে যান নওয়াজও। অভিভূত শরিফ পরিবারের থেকে বিদায় নিয়ে দেশে ফিরে সুষমা যান মোদীর কাছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানান, নওয়াজ চাইছেন তিনি যেন এক বার পাকিস্তানে যান।
আরও পড়ুন, পাক-প্রশ্নে রাশ হাতে রাখছেন প্রধানমন্ত্রী
গত কাল লাহৌরে গেলেন মোদী। সুষমার সফরের পর দু’সপ্তাহ গড়াতে না গড়াতেই। সেই বাড়িতেই নওয়াজের মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন ‘নরেন পুত্তর’। কিন্তু এত নাটকীয় সফরের কথা খোদ সুষমাই আগাম টের পেলেন না! সূত্র বলছে, মোদীর পাকিস্তান যাওয়ার ব্যাপারে বিদেশমন্ত্রী বা তাঁর মন্ত্রকের কাছেই কোনও আগাম খবর ছিল না। গত কাল মোদী যখন কাবুল-ফেরত লাহৌরে থামার কথা টুইটারে ঘোষণা করেন, তখন সেটি ‘রিটুইট’ করে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেছিলেন সুষমা। তাতে অবশ্য বিরোধীদের সমালোচনা এড়াতে পারেননি মোদী। প্রশ্ন উঠেছে তাঁর পাক-নীতি নিয়ে।
কারণ একাধিক। প্রথমত, মোদী নিজেই আগে বলেছিলেন, পাক নীতির ক্ষেত্রে চিন মডেল অনুসরণ করা ভাল। অর্থাৎ কথাবার্তা হোক, কিন্তু মৈত্রী নিয়ে অতিনাটকীয়তার দরকার নেই। কিন্তু মোদী নিজেই এখন সেই কথা মানছেন না বলে বিরোধীদের দাবি। দ্বিতীয়ত, হুরিয়ত নেতারা পাক হাইকমিশনে এসেছিলেন বলে বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করে দিয়েছিলেন মোদী। সেই তিনিই যে এখন ‘দোস্তি’র পথে হাঁটছেন, সেটা মার্কিন চাপে কি না— প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। এবং তৃতীয়ত, মোদীর এই সক্রিয়তায় ক্ষুব্ধ সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপির জোটসঙ্গী শিবসেনার একাংশ। এর পরেও পাকিস্তানের তরফে সন্ত্রাসে মদত দেওয়া বন্ধ হবে কি না, পাকিস্তানে ঘাঁটি গাড়া দাউদ ইব্রাহিমকে ভারত আদৌ হাতে পাবে কি না, ভারত-পাক সম্পর্কে সবচেয়ে বড় যে কাঁটা, সেই কাশ্মীর প্রশ্নে কোনও অগ্রগতি হবে কি না, সেই সব প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই নিয়ে ছ’বার বৈঠক হল মোদী-নওয়াজের। মোদীর শপথে দিল্লি আসেন নওয়াজ।
তার পর নিউ ইয়র্কে, সার্ক সম্মেলনের ফাঁকে কাঠমান্ডুতে, জি-৮-এর সম্মেলন চলাকালীন রাশিয়ার উফায় কথা হয়েছে দুই নেতার। তার পর প্যারিস এবং গত কাল লাহৌর।
আরও পড়ুন, মোদীর গোপন দূত কি জিন্দল, বিতর্ক দিল্লিতে
তা সত্ত্বেও যে প্রশ্নটা বারবার উঠছে— এত ঘন ঘন নওয়াজের সঙ্গে বৈঠক করে দিল্লির সত্যিই কতটা লাভ? বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর আগামী মাসেই ইসলামাবাদে বৈঠকে বসছেন পাক বিদেশসচিবের সঙ্গে। ২০১৬ সালে সার্ক সম্মেলনও হবে পাকিস্তানে। কিন্তু বিদেশসচিবেরও অভিমত হল, নওয়াজ তো বরাবরই ভাল ভাল কথা বলেন। কিন্তু ভারত-পাক সম্পর্কের কূটনৈতিক ভবিষ্যতের চাবিকাঠি কি তাঁর হাতে আছে?
অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কায় সার্ক সম্মেলনে। ১৯৯৮-এর জুলাইয়ে সেই সফরে কলম্বোর ‘তাজ সমুদ্র’ হোটেলে নওয়াজের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বাজপেয়ী। নওয়াজ তখনও বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চান তিনি। এর পর সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে ফের বাজপেয়ী-নওয়াজ বৈঠক হয়। সে বার নিউ ইয়র্ক প্যালেস হোটেলে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা হয় লাহৌর বাসযাত্রা কর্মসূচির। কিন্তু বাসের চাকা গড়াতে না গড়াতেই বেধে যায় কার্গিল যুদ্ধ। তার পর পারভেজ মুশারফের সামরিক অভ্যুত্থান, আগরায় বাজপেয়ীর সঙ্গে তাঁর বৈঠক করতে আসা। নওয়াজের ভবিতব্য কী হয়েছিল? নিজের দেশ থেকেই বিতাড়িত হয়েছিলেন তিনি।
আসলে পাকিস্তান কোনও দিনই ‘একটা’ পাকিস্তান নয়। সে দেশে নির্বাচিত সরকারের উপরে ক্রমাগত ছড়ি ঘোরায় পাক সেনাবাহিনী, আইএসআই এবং মোল্লাতন্ত্র। ভারত-পাকিস্তান আস্থার পথে হাঁটলেই এরা বাগড়া দিতে শুরু করে। কাল মোদীর সফরের পরেই লস্কর-প্রধান হাফিজ সইদ তোপ দেগেছেন নওয়াজকে। বলেছেন, ‘শত্রুকে’ কেন এ ভাবে বাড়িতে স্বাগত জানাচ্ছেন নওয়াজ?
শুধু স্বাগত জানানো নয়, মোদীকে গত কাল নওয়াজ বলেছেন, ‘‘এ তো আপনারই বাড়ি!’’ মোদী বলেছেন, ‘‘এ বার তো যাতায়াত লেগেই থাকবে।’’ আমেরিকার পাশাপাশি আজ রাষ্ট্রপুঞ্জও স্বাগত জানিয়েছে সেই উষ্ণতাকে। তবে কূটনীতিকরা অনেকে বলছেন, বাইরে নাটক যতই হোক, ঘরোয়া জমিতে সতর্ক পা ফেলেই এগোতে হচ্ছে দুই প্রধানমন্ত্রীকে। মোদী যেমন বাজপেয়ীর পথে হাঁটতে চাইলেও কার্গিলের স্মৃতি ভুলে যেতে পারেন না। বরং শরিফের অতিথি হয়ে তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতার অভিযোগ খণ্ডন করতে চাইলেন কি না, চর্চা চলছে তা নিয়ে। অন্য দিকে শরিফও জানেন, সেনা-আইএসআই-মোল্লাতন্ত্রের নিঃশ্বাস ঘাড়ে নিয়েই সরকার চালাতে হবে তাঁকে।
আর তাই মোদী-নওয়াজ পরস্পরের হাত ধরলেও কাশ্মীর আলোচনায় চোখে পড়ার মতো কোনও অগ্রগতি এখনও দূর অস্ত্!