সহযোদ্ধা: মালালা-মুজ়ুন (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই কেটে যাচ্ছিল ছোটবেলা। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুল, স্কুল থেকে ফিরে খাওয়া, পড়াশোনা। বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আবার একটু পড়াশোনা। এটাই ছিল মুজ়ুনের রোজনামচা।
মুজ়ুন, মানে মুজ়ুন আলমেলেহান। রাষ্ট্রপুঞ্জের কনিষ্ঠতম শুভেচ্ছাদূত। তবে এই তিনটে শব্দেই তাঁর পরিচয় শেষ হয়ে যায় না। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে জর্ডনের শরণার্থী শিবির। তার পর এখন ব্রিটেনের নিরাপদ আশ্রয়ে। অনেকটা পথ হেঁটে আজ এখানে এসে পৌঁছেছেন মুজ়ুন। কেমন সেই পথচলা? শুনে নেওয়া যাক মুজ়ুনের নিজের মুখেই।
‘‘আমার জন্ম সিরিয়ার দরা শহরে। সেখানেই কেটেছিল জীবনের প্রথম বারোটা বছর। মা-বাবা, কাকা-কাকিমা, সবাইকে নিয়ে নির্বিঘ্নে, আনন্দে। ছবিটা পাল্টে গেল ১৩ বছরে পা দেওয়ার মাসখানেক আগে,’’ আনন্দবাজারকে ই-মেলে জানালেন মুজ়ুন।
২০১১-র মার্চ। সিরিয়ায় শুরু হল গৃহযুদ্ধ। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বাথ বাহিনীর সঙ্গে সরকার-বিরোধী গোষ্ঠীর লড়াই। জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস সেই পরিস্থিতিকে আরও রক্তক্ষয়ী করে তুলল। বোমা, গুলি আর ক্ষেপণাস্ত্রে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল মুজ়ুনের মতো অনেকের শৈশব।
সিরিয়া ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা ছিল না মুজ়ুনের মা-বাবার সামনে। দুই কিশোরী কন্যা ও ছোট দু’টি ছেলেকে নিয়ে দেশ ছাড়েন এমান ও রাকান আলমেলেহান। ঠাঁই মেলে জর্ডনের জ়াতারি শরণার্থী শিবিরে। মুজ়ুনের কথায়, ‘‘সব কিছু ফেলে রেখে চলে আসতে হয়েছিল আমাকে। ফেলে এসেছিলাম আমার শৈশব। কাকা-কাকিমা, চেনা মহল্লা, পাড়ার বন্ধুরা, স্কুল— সব কিছু। কিছুই আনতে পারিনি সঙ্গে করে, শুধু স্কুলের কয়েকটা বই ছাড়া। আর একটা খাতা, যেখানে বন্ধুরা সবাই দু’-চার লাইন করে লিখে দিয়েছিল।’’
আরও পড়ুন: ৬৮ বছর পার, ছেলেকে দেখতে মরিয়া লি কেউম
মুজ়ুন বললেন, ‘‘প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগত। তবে জ়াতারি শিবিরে গিয়ে দেখলাম, স্কুল রয়েছে। পড়াশোনা চালানোর সুযোগ রয়েছে। আস্তে আস্তে ভয় কমল। মনে হল, বাঁচতে আমাকে হবেই। লড়াই থামালে চলবে না।’’
কেমন ছিল শরণার্থী শিবিরের সেই লড়াই? ‘‘খুব কঠিন’’ বললেন মুজ়ুন। ‘‘তত দিনে বুঝে গিয়েছি, ঠিক মতো বাঁচতে হলে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে।’’ শুধু নিজের নয়, পড়াশোনা চালানোর এই অদম্য ইচ্ছেকে মুজ়ুন ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল শরণার্থী শিবিরের আর পাঁচটা বাচ্চার মধ্যেও। মুজ়ুনের কথায়, ‘‘বাচ্চাদের বোঝানোর চেষ্টা করতাম, ঘুরে না-বেড়িয়ে পড়াশোনা করা দরকার। তার সঙ্গে তাদের মা-বাবাকেও বোঝানোর দরকার ছিল। সেটা আরও কঠিন লড়াই। শরণার্থী শিবিরের অনেক মা-বাবা বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের সঙ্গে বয়সে অনেক বড় লোকেদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলেন। তাঁদের বোঝাতে চেষ্টা করতাম, শুধু ছেলে নয়, মেয়েদেরও পড়াশোনা করা খুব জরুরি।’’
এই জ়াতারি শরণার্থী শিবিরেই মুজ়ুনের সঙ্গে প্রথম দেখা মালালা ইউসুফজ়াইয়ের। পাক কিশোরী মালালার নামের পাশে তখনও ‘শান্তির নোবেলজয়ী’ শব্দবন্ধটি বসেনি। তবে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছে ‘মালালা তহবিল’, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দুঃস্থ শিশুদের শিক্ষার সুযোগসুবিধে করে দেওয়ার জন্য। সেই তহবিলের কাজেই সিরিয়ার শরণার্থী শিবিরে এসেছিল কিশোরী মালালা। পরে এক সাক্ষাৎকারে মালালা জানিয়েছিলেন, জর্ডনের সেই শিবিরেই এক সিরীয় কিশোরী তাঁকে বলেছিল, ‘তোমার কথা শুনেছি বটে। তবে আমাদের রোল মডেল— মুজ়ুন! ও-ই আমাদের ঠেলে ঠেলে স্কুলে পাঠিয়েছে!’ শরণার্থী শিবিরে ঘুরতে ঘুরতে মালালার সঙ্গে যে বন্ধুত্বের সূত্রপাত, ব্রিটেনে আসার পরে তা আরও গাঢ় হয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কারের অনুষ্ঠানেও মুজ়ুনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মালালা। পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমই মুজ়ুনকে ‘সিরিয়ার মালালা’ নাম দিয়েছে।
২০১৫ সালে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের ব্যবস্থাপনায়, সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে শুরু করে ব্রিটেন। প্রথম যে এক হাজার শরণার্থী সে দেশে পা রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিল মুজ়ুনের পরিবারও।
গত বছর শিশুদের প্রকল্প ‘ইউনিসেফ’-এর শুভেচ্ছাদূত হিসেবে মুজ়ুনকে বেছে নিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। এর আগে কোনও শরণার্থী এই পদে আসেননি। পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে মুজ়ুন গিয়েছিলেন জর্ডনের সেই জ়াতারি শরণার্থী শিবিরে। ‘‘আলাপ হল সেদ্রার সঙ্গে। আমার মতোই সিরিয়া ছেড়েছিল মাত্র দশ বছর বয়সে। দু’বছর স্কুলের মুখ দেখেনি। কিন্তু এখন আবার পড়াশোনা শুরু করেছে। শুরু করেছে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখতে। সেদ্রার মতো মেয়েরাই শরণার্থী জীবনে আশার রোশনাই,’’ লিখেছেন মুজ়ুন।
রাষ্ট্রপুঞ্জের কাজ। তার সঙ্গে পড়াশোনা। ব্যস্ততার ফাঁকে আর কী করেন? ‘‘রান্না করতে ভাল লাগে। আর ভাইয়ের সঙ্গে ফুটবল খেলতে। তা ছাড়া, ছবি তোলা আমার নেশা। সময় পেলেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সাংবাদিক হবো।’’ প্রত্যয়ী শোনালো উনিশের কলম।