রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরে কলম্বোর রাস্তায় সমর্থকদের উল্লাস। পিটিআই
ধন্যবাদ শ্রীলঙ্কা। চরম টালমাটাল এই সন্ধিক্ষণেও নিজের সংবিধানে আস্থা রাখার জন্য। গণতন্ত্রকে কুর্নিশ জানিয়ে নিজের আইনের গণ্ডির মধ্যেই নতুন প্রেসিডেন্ট বেছে নেওয়ার জন্য।
এক মাস আগেও ভীষণ অস্থির ছিল এই দেশ। আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তার সেই দমবন্ধ দোলাচলে কেউই জানত না, কী হতে চলেছে শ্রীলঙ্কার। দেশে সংঘর্ষ বেধেছে, বিক্ষোভ হয়েছে, খুচরো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি এমনও ভয় ছিল, এই বুঝি সেনা নেমে গেল।
এখনও অবশ্য অনেকটা পথ বাকি। তীব্র আর্থিক সঙ্কট ও তার জেরে আমজনতার অসন্তোষের মেঘ পুরো কাটতে দেরি আছে। কিন্তু অনেক সময়ে প্রথম পদক্ষেপ দেখেই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভরসা আসে। আজ এমপি-দের গোপন ব্যালটে নথিভুক্ত ২২৩টি ভোটের মধ্যে ১৩৪টি ভোট পেয়ে রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে কোথাও যেন সেই ভরসাটাই পেলাম। সঙ্কটমুক্তির চেষ্টায় একটা সর্বদলীয় উদ্যোগ তো দেখা গেল।
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের দল এসএলপিপি-র ভরসায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন রনিল। আবার সেই এসএলপিপি-রই বিদ্রোহী নেতা ডালাস আলাহাপ্পেরুমা ছিলেন তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রধান বিরোধী দল এসজেবি-র নেতা সাজিথ প্রেমদাসা শেষ মুহূর্তে প্রেসিডেন্টের দৌড় থেকে সরে দাঁড়িয়ে ডালাসের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। ডালাস জিতলে তিনি সাজিথকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিতেন। এখন অবশ্য প্রধানমন্ত্রী বাছবেন রনিল। সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এসএলপিপি নেতা দীনেশ গুণবর্ধনের নাম শোনা যাচ্ছে।
রনিলের সামনে কিন্তু অনেক চ্যালেঞ্জ। একে তো, তাঁকে এই মুহূর্তে জনপ্রিয় নেতা বলা যাবে না। রনিলকে কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্ট মনোনীত করেছিলেন গোতাবায়া। অনেকেই তা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন, আদতে রাজাপক্ষেরাই নেপথ্যে কলকাঠি নাড়বেন। ‘আরাগালিয়া’ নামে যে প্রতিবাদী সংগঠন এখানকার বিক্ষোভের মূল হোতা, তারা এখনও মনে করছে, প্রেসিডেন্ট হওয়ার নৈতিক অধিকার রনিলের নেই। কারণ, পার্লামেন্টে তিনি নিজে ছাড়া তাঁর দল ইউএনপি-র আর কোনও প্রতিনিধি নেই। কলম্বোর গল ফেসে বসে থাকা প্রতিবাদীরা বলেছেন, রনিল ইস্তফা না দেওয়া পর্যন্ত তাঁদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলবে।
একটা পঙ্গু সরকারকে অর্থনৈতিক-সহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আবার সচল করে তোলার গুরুদায়িত্বই এখন রনিলের কাঁধে। আমার মতে, খাবার, জ্বালানি তেল আর ওষুধের সরবরাহ অটুট রাখা এবং তার সুষম বণ্টনই এখন প্রেসিডেন্টের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। দেশে বিদেশি মুদ্রার অভাব সত্ত্বেও মনে হয়, রনিল সেটা পারবেন। বর্তমান অবস্থা থেকে শ্রীলঙ্কাকে উদ্ধার করতে হলে এমন কারও কর্তৃত্ব এখন দরকার, যিনি নিজের অভিজ্ঞতার জোরে দেশের অর্থনীতি আর কূটনীতির মধ্যে ভারসাম্য রেখে এগোবেন। ছ’বারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আন্তর্জাতিক মঞ্চে রনিলের যোগাযোগ ও গ্রহণযোগ্যতা অনেকের চেয়েই বেশি। ধরে নিতে পারি, ঋণ হিসেবে ভারত-সহ বিভিন্ন দেশের সাহায্য পাওয়া কিংবা আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার আলোচনা— সবই এখন আরও গতি পাবে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে শ্রীলঙ্কায় পর্যটনও পুরনো উদ্যমে শুরু করা যাবে। আসবে বিদেশি মুদ্রা।
আজ শান্তিতেই ছিল কলম্বো। অফিস গিয়েছিলাম। পেট্রল পাম্পে ভিড় এড়াতে সরকার অনলাইনে গাড়ির নম্বর রেজিস্ট্রি করে ‘কিউআর কোড’ দেওয়া শুরু করেছে। সকলেই নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্বালানি পাবেন। গত সপ্তাহে এ ব্যবস্থা যখন চালু হয়, তখন রনিলই কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্ট।
এখন তিনিই প্রেসিডেন্ট। আশা করতে ক্ষতি কী?
(লেখক একটি ভারতীয় সংস্থার বিভাগীয় প্রধান)