নামেই ইমারত। নিয়মমাফিক দরজা-জানলা-ঘরও আছে। অথচ দেখতে কোনওটা পাখি, কোনওটা মাছ, কোনওটা বিশাল কচ্ছপের মতো। এমনকি দুমড়ে ফেলা কাগজের ঠোঙার মতো দেখতে বহুতলও আছে। বছরের পর বছর ধরে বহু পরিকল্পনা, পরিশ্রম করে মাথা খাটিয়ে সেইসব ইমারতের নকশা বানিয়েছেন স্থপতিরা। নতুন পুরনো মিলিয়ে সেই সব স্থাপত্য একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
দোমড়ানো কাগজের ঠোঙার মতো দেখতে বহুতলটি সিডনির। এর ভিতরে আছে একটি বিজনেস স্কুল— সিডনির ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি। বিজনেস স্কুলে গ্রাহকদের মন বোঝার পাঠ পড়ানো হয়। গ্রাহক দোকান থেকে জিনিস কেনার পর দুমড়ে ফেলে দেন ব্যবহার হয়ে যাওয়া কাগজের ঠোঙা। এ রকমই কিছু ভাবনা থেকে বিজনেস স্কুলের বাড়িটি দোমড়ানো কাগজের ঠোঙার মতো বানিয়েছিলেন স্থপতি ফ্র্য়াঙ্ক গেরি। স্কুলটি ছাত্র ছাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়ার অনুষ্ঠানে ফ্র্যাঙ্ক বলেছিলেন, ‘‘আমার কাছে এটাই দুনিয়ার সেরা কাগজের ঠোঙা। আর কোথাও এই জিনিস তৈরি করব না।’’
লস অ্যাঞ্জেলেস-এর স্থপতি ফ্র্যাঙ্কের বিশেষত্ব ঢেউ খেলানো ইমারত তৈরিতে। তাঁর তৈরি বাড়ি হঠাৎ দেখলে মনে হয় তা শরীর বাঁকিয়ে ব্রেক ডান্স করছে। ফ্র্যাঙ্ককে তাই নাচতে জানা বাড়ি বা ডান্সিং বিল্ডিংয়ের স্থপতি বলা হয়। সিডনিতেও নিজের সেই স্বাচ্ছন্দের জায়গা থেকেই দুমড়ে ফেলা ঠোঙার মতো এই বহুতলটি তৈরি করেন তিনি। ৩ লক্ষ ২০ হাজার বিশেষ আকৃতির ইট লেগেছিল বাড়িটি তৈরি করতে।
জাপানে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড লুই ভিত্তোঁ-র শো-রুম দেখলে মনে হতে পারে এক টুকরো সমুদ্র। তবে এ-সমুদ্র লম্বাটে। মাটি ফুঁড়ে উঠে আসা জলের স্তম্ভের মতো। টোকিয়োর এই শো-রুমটি তৈরি করেছে নির্মাণ সংস্থা জুন আওকি এ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। কাছেই গিনজার উপকূল। ঢেউ খেলানো কাচের দু’টি স্তর দিয়ে তৈরি হয়েছে পাঁচতলা শোরুমের দেওয়াল। আকাশের পাশাপাশি তাতে ছায়া পড়ে সমুদ্রেরও।
মুরগীর আকৃতির গির্জা। জাভায় সেই গির্জা দেখতে ভিড় জমান পর্যটকরা। ৬৭ বছরের স্থপতি ড্যানিয়েল অ্যালামসজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে গির্জাটি বানিয়েছিলেন। তবে তিনি পায়রা বানাতে চাইলেও স্থানীয়দের কাছে গির্জাটির পরিচিতি ‘চিকেন চার্চ’ নামেই।
কোরিয়ার সাইমুনান গির্জা আবার ঝকঝকে আধুনিক। কোরিয়ার এই গির্জা তৈরির কাজ শেষ হয়েছ ২০১৯ সালে। স্থপতি লি ইউনসিওক বলেছিলেন, সাধারণ ইমারত বানানো আর গির্জা বানানো এক কথা নয়। অনেক বিষয় মাথায় রাখতে হয়। মানুষ সেখানে প্রার্থনা করবেন। মানসিক শান্তির খোঁজে আসবেন। চারটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়েছিল তাঁকে। ঐতিহাসিক যোগ, গির্জাকে স্বর্গের দরজা বলা হয় যে প্রতীকী অর্থে, তা বজায় রাখা, ঈশ্বরকে আলো হিসেবে দেখানোর যে ধারণা রয়েছে, তা বজায় রাখা এবং গির্জার ভিতরে এমন কোনও জলাশয় রাখা যা খ্রিষ্ঠ ধর্মের প্রতীক এবং ব্যাপ্টিজমের প্রতীক হিসেবে দেখা হবে।
গাছের মতো বাড়ি। তবে ট্রি হাউস নয়। ফ্রান্সের লারব্রে ব্লাঁ টাওয়ারের এক একটা বারান্দা গাছের শাখার মতো। মূল কাঠামো থেকে বাইরে ঝুলে থাকা। বাসিন্দাদের খোলামেলা আকাশের নীচে থাকার অনুভূতি দিতেই নাকি এমন ব্যবস্থা। স্থপতি নিকোলাস লেইনের কথায়, এর বারান্দাগুলির অদ্ভুত অবস্থান পড়শিদের মধ্যে সম্পর্কও ভাল করে। ১৭ তলা বাড়িটিতে মোট ১১৩টি অ্যাপার্টমেন্ট আছে।
পিরামিড বাড়ি। তবে এই পিরামিড ওল্টানো। মাথাটা চওড়া। তলা সূচালো। স্পেনের পাহাড় ঘেরা গ্রামীণ এলাকায় এই ওল্টানো পিরামিডই আপাতত অবস্থাপন্নদের বিশ্রামবাড়ি হয়ে উঠছে। জঙ্গল আর পাহাড়ের মাঝামাঝি ওই বাড়ির দেওয়ালগুলোই সিঁড়ি। সেই সিঁড়ির ঢাল ঘেঁষে কোথাও বসার ঘর কোথাও রান্নার জায়গা। আছে সুইমিং পুলও। আর তারও আকৃতি পিরামিডের মতোই।
দরজা খুলে সোজা ঈশ্বরের শরীরের ভিতর ঢুকে পড়া যাবে চিনের একটি হোটেলে। চিনের মিয়াং রাজত্বের সময়ের এই তিন দেবতার নাম শৌ, ফু আর লু। শৌ অমরত্বের দেবতা, ফু ভাগ্য এবং লু সমৃদ্ধির দেবতা। এই তিন দেবতার বিশালমূর্তির ভিতরে লুকনো গোটা হোটেলটাই। হেবেই প্রদেশের ওই হোটেলের নাম তিয়ানজি। এই তিয়ানজি শব্দের অর্থ হল স্বর্গের পুত্র।
সিঙ্গাপুরের এই বহুতলের নাম ইন্টারলেস। ২০১৫ সালে বিশ্বের সেরা ইমারতের শিরোপা পেয়েছিল ইন্টারলেস। তবে বহুতল হলেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই ভাবে ওঠার একঘেঁয়েমি নেই। বরং বেশ কিছু তল পরে যেন ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে বাড়ির অভিমুখ। জায়গা পেয়েছে ছাদ। তৈরি হয়েছে পেন্ট হাউস। ১.৭০ লক্ষ বর্গ মিটার জুড়ে তৈরি এই ইন্টারলেসের চার পাশে রয়েছে ৮ হেক্টর ফাঁকা জায়গা। মোট ৩১ টি ব্লক রয়েছে এই বহুতলে।
হায়দরাবাদের ফিশ বিল্ডিং বা মৎস্য ভবন আসলে জাতীয় মৎস্য দফতরের আঞ্চলিক অফিস। ২০১২ সালে তৈরি করা হয় বাড়িটি। স্থপতি ফ্র্যাঙ্ক গেরির বার্সালোনায় তৈরি ফিশ স্কাল্পচার দেখে অনুপ্রাণিত বাড়িটি। বিশাল ওই মাছের ভিতরে রয়েছে চার তলা অফিস।
ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমির মধ্যে ক্যাকটাসের ফুলের মতো দেখতে একখানা বাড়ি। তবে ইঁট-কাঠ-পাথরের নয়, এই বাড়ি তৈরি হয়েছে জাহাজের কন্টেনার দিয়ে। এখনও সম্পূর্ণ হয়নি বাড়িটি তৈরির কাজ। তবে এরই মধ্যে ৩৫ লক্ষ ডলার দাম উঠেছে ওই বাড়ির।
অর্ধচন্দ্রাকৃতি বহুতল। ইসলামের সঙ্গে প্রাণের যোগ বোঝাতে এই ইমারত তৈরির পরিকল্পনা করেছিল দুবাই। ৩৩ তলা ইমারতটি তৈরি হওয়ার কথা জাবিল পার্কে দুবাই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কাছে। যদিও এখনও সেই ইমারত তৈরির কাজ শুরু হয়নি।
জীব জন্তুর আকৃতির বাড়ি দেখা যায় নিউজিল্যান্ডের ছোট্ট শহর তিরাউয়ে। ৮০০ বাসিন্দার এই ছোট্ট শহরের পথে ঘুরলেই দেখা যাবে কুকুর, ভেড়া, বেড়ালের আকৃতির বাড়ি। এই বাড়ি গুলির কোনওটা পর্যটন কেন্দ্র, কোনওটা আবার উলের তৈরি জিনিসপত্র বা উপহারের দোকান।
চিনের বেইয়াং হ্রদের কাছে সম্প্রতি তৈরি হয়েছে গোল্ডেন টার্টল প্যাভিলিয়ন। ৬৮ মিটার দীর্ঘ ৪৬ মিটার চওড়া এক বিশাল কচ্ছেপের আকৃতির ইমারত। এখনও সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি এই প্যাভিলিয়ন।
ছবির ফ্রেমের আকারের এক বিশাল ইমারত। নাম ‘ফ্রেম’। এই ফ্রেমের একপাশে রয়েছে দুবাইয়ের প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত এলাকা। অন্যদিকে আধুনিক শহর। ‘ফ্রেম’ আধুনিক আর প্রাচীন দুবাইয়ের মধ্যে এক যুগান্তরের জানলার মতো দাঁড়িয়ে। ১৫০ মিটার দীর্ঘ ফ্রেমের সর্বোচ্চ তলে পৌঁছতে সময় লাগে ৭৫ সেকেন্ড। সেখান থেকে গোটা দুবাইকে দেখা যায়।