মা ও মেয়ে। টুইটার
গর্ভে সন্তান। ভরসা করেছিলেন প্রেমিককে। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলেন মনের মানুষের সঙ্গে। কিন্তু সেই মানুষই দূরের হয়ে যান আচমকা। সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগেই প্রসূতি ফারহিনকে ফেলে ফেরার হন প্রেমিক। ততদিনে পরিবারের সঙ্গে দূরত্বও অনেকটা।
কিন্তু পিছিয়ে আসেননি ফারহিন। ‘একলা মেয়ে’ থেকে ‘একলা মা’ হয়ে ওঠেন তিনি। জন্ম নেয় তাঁর কন্যা। কিন্তু সমাজ সহজে ছেড়ে দেয় না। তাই ‘পুরুষ’ সেজে ‘বাবা’ পরিচয়ে মেয়ে মানুষ করে চলেছেন লাহৌরের ফারহিন ইস্তিহাক।
কলকাতা শহরে বৃহস্পতিবার ‘একলা মা’ হয়ে ওঠা নুসরত জাহানের জীবন কতটা কঠিন হতে পারে, তা আনন্দবাজার অনলাইনের মাধ্যমে তাঁকে জানিয়েছেন শহরের দুই ‘একলা মা’ অনিন্দিতা সর্বাধিকারী এবং ইলিনা বণিক। সেই প্রেক্ষিতেই আনন্দবাজার অনলাইন খুঁজে পেয়েছে পাকিস্তানের ফারহিনকে।
ফারহিনের কথা প্রথম পৃথিবীকে জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের লেখক জাইন উল হাসান। একটি টুইট করে তিনি ছবি-সহ জানিয়েছিলেন ফারহিনের কাহিনি। ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁর টুইটার হ্যান্ডলে ‘পিনড’ (সবার উপরে) করে রাখা রয়েছে সেই কাহিনি। ফারহিনের তখন বয়স ছিল ৪১।
লাহৌর শহরে আনারকলি বাজারে ছোট্ট একটি দোকান আছে ফারহিনের। প্রতিদিন পুরুষদের পোশাকেই তিনি দোকানে বসেন।সকলে তাঁকে পুরুষ হিসেবেই চেনে। ফারহিন জানিয়েছিলেন, মানুষের কৌতূহল আর অপছন্দের প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই ওই পথ নিয়েছেন তিনি। সমাজ যে ‘একলা মা’-দের সহজে মেনে নেয় না, তা বুঝতে পেরেই‘মা’ হয়েও সন্তানের ‘বাবা’ সেজে থাকার পথ বেছে নেন তিনি।
তাঁর কাহিনি জানাজানি হওয়ার সময় ফারহিনের কন্যা রিদা জাহরার বয়স ন’বছর। লাহৌরের একটি গার্লস হস্টেলে ‘একলা’ থাকেন মা-মেয়ে। সে ভাবে আর কোনও স্বজন নেই তাঁদের। ফারহিনের বাড়ি ছিল করাচিতে। এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে গেলে আপত্তি তোলে পরিবার। তখন তাদের অমতেই বিয়ে করবেন বলে ঠিক করেন। কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়অন্য দিকে।
ফারহিনের কথায়, ‘‘২০১০ সালে বিয়ে করব বলে ঠিক করি। যাকে ভালবাসতাম, সে আলাদা জাতের হওয়ায় বাড়ির কেউ মেনে নেননি। খুব চিন্তায় ছিলাম।’’ অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর ফারহিনকে ছেড়ে চলে য়ান তাঁর প্রেমিক। ফারহিন বলেছেন, ‘‘কারও কোনও সাহায্য ছাড়াই হাসপাতালে ভর্তি হই। কিছু জটিলতাও ছিল। চিকিৎসকদের বলেছিলাম, আমার কিছু হয়ে গেলে আমার সন্তানকে যেন আমার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।’’
নির্বিঘ্নেই জন্ম নেয় ফারহিনের কন্যাসন্তান। কিন্তু নতুন লড়াই শুরু হয় তাঁর। ‘একলা মা’ হিসেবে সন্তান পালন করবেন বলে ঠিক করে নিলেও শুরুটা সহজ ছিল না।ফারহিনের কথায়,‘‘ঠিক করেছিলাম, মেয়েকে এমন ভাবে মানুষ করব, যাতে অন্তত আমার চেয়ে ভাল জীবন পায়।’’ করাচি থেকে সাড়ে ৮০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে পঞ্জাব প্রদেশের মুলতান শহরে এক বান্ধবীর কাছে মেয়েকে রেখে আসেন ফারহিন। কারণ, ‘‘তখন আমার উপার্জন করাটাও জরুরি। মেয়ের খেয়াল রাখা এবং রোজগার একসঙ্গে সম্ভব ছিল না।’’
প্রথমে একটি রেস্তরাঁয় ওয়েটারের কাজ নেন ফারহিন। কিন্তু আবার নতুন সমস্যা তৈরি হয়। বছর দেড়েক পর বান্ধবী ফারহিনকে জানান, তাঁর পক্ষে আর শিশুটির দেখভাল সম্ভব নয়। তখন একবার নিজের বাবা-মায়ের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন ফারহিন। বলেন, ‘‘আমি চেয়েছিলাম, আমায় মেয়ে হিসেবে মেনে নিতে না পারলেও তাঁদের নাতনিকে কিছুদিন দেখবেন তাঁরা। চার বছর মেয়ে ওখানে ছিল। ততদিনে আমি নিজেকে অনেকটাই গুছিয়ে নিই। পরে লাহৌরে একটি গার্লস হস্টেলের খোঁজ পাই যেখানে মেয়েকে নিয়ে থাকা এবং কাজ দুইই করা যাবে। সেই থেকে লাহৌরই আমার শহর।’’
নতুন শহরে ‘একলা মা’ হিসেবে থাকাটা যতটা সহজ মনে করেছিলেন ফারহিন, ততটাও মসৃণ হয়নি পথ। সেই সময়ের কথা জানিয়ে ফারহিন বলেছেন, ‘‘আনারকলি বাজারের মতো একটা ব্যস্ত এলাকায় কোনও মহিলার পক্ষে একলা দোকান চালানো সহজ ছিল না। পাকিস্তানের মতো পুরুষশাসিত সমাজে মহিলাদের প্রকাশ্যে হেনস্থা করাটা খুবই সাধারণ বিষয়। নানা রকম কটূক্তি, শারীরিক হামলা, যৌন হেনস্থার শিকার হওয়ার ভয়।’’
সেই সমস্যা থেকেই বাঁচতে ‘একলা মা’ নিজের বহিরঙ্গ বদলে ‘বাবা’ সাজতে শুরু করেন। ফারহিন বলেছেন, ‘‘আমি সবসময়ই একটু টমবয় প্রকৃতির। ব্যবসা চালানোর জন্য এটা আমার বেশ ভাল উপায় বলে মনে হয়েছিল।’’
সমাজের ‘কুনজর’ থেকে বাঁচতে একটা ছদ্মনামও নিয়েছেন ফারহিন— ‘আলি’। অপরিচিতরা বুঝতে পারেন না ‘আলি’র আড়ালে আছেন একজন ‘মা’। একলা মা।