শেখ মুজিবর রহমান। —ফাইল চিত্র
১৯৭৫-এর ১৫ অগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘন্টা পরেই উল্টো পথে চলা শুরু হয়েছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনী, বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ বদলে গিয়েছিল— বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয়েছিল ‘রেডিও বাংলাদেশ’। একই সঙ্গে আক্রান্ত হচ্ছিল বাঙালিয়ানার সেই ভিত্তিগুলো, ১৯৭১ সালে যাদের উপর দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। দেশের জেলখানাগুলো পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা আর প্রগতিশীল মানুষে। শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ অগস্টের পর থেকে বঙ্গবন্ধু হিসেবে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। সব পাঠ্যপুস্তক থেকেই মুছে ফেলা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম। আওয়ামি লিগ-সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর উপরে চলে ধারাবাহিক নির্যাতন।
সেই সময়ের বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানপন্থী দর্শনে বিশ্বাসীদের অভয় উত্থানের উর্বর জনপদ। সে এক অন্ধকার বাংলাদেশ— নাম আর জাতীয় পতাকা ছাড়া দেশটির সব আবহেই পাকিস্তানী ভাবধারার জয়জয়কার। অন্য দিকে চিনের পাকিস্তান প্রীতি বাংলাদেশ প্রশ্নে এত বেশি ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর জীবিতকালে তারা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের স্বীকৃতিও দেয়নি। ১৫ অগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর চিন বাংলাদেশকে ১৯৭৫ সালের ৩১ অগস্ট স্বীকৃতি দেয়।
এক দিকে মুখ থুবড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অন্য দিকে প্রশাসন-রাজনীতি সব জায়গায় সদম্ভে পাকিস্তানী ভূত। জাতির জনকের হত্যার এক বছরের মাঝেই জেলখানা থেকে স্বদম্ভে বেড়িয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী— আলবদর রাজাকার। ১৯৭৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষার জন্য ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গ ওই হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি শাস্তি যাতে কখনওই না দেওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা করতেই বাংলাদেশে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইনটির পরবর্তী কালে সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে এই সেনাশাসকের সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা আছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গবেষকদের মাঝে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সময়ে দেশের বাইরে ছিলেন তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সে কারণেই পরিবারের সব সদস্য সে দিন নিহত হলেও তাঁরা দু’জনে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা স্বামী, সন্তান-সহ ছ’বছর বিদেশে কাটিয়ে দুই শিশু সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে লন্ডনে ছোট বোন শেখ রেহানার কাছে রেখে ১৯৮১ সালের ১৭ মে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে ফেরেন।
দীর্ঘ দিন পরে দেশে ফেরা শেখ হাসিনার জন্য মোটেও আনন্দের ছিল না। ছিল বেদনা আর আবেগের। তার ফিরে আসার দিনটিইও যেন সেই সময়ের বাংলাদেশের রাজনীতির মতোই। প্রকৃতিও যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনা আর বাঙালির আবেগের সঙ্গে। ১৯৮১-র ১৭ মে সকাল থেকেই কালবৈশাখীর প্রবল ঝোড়ো হাওয়া। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় সে দিন বিমানবন্দরমুখী লাখো মানুষ। প্রবল বৃষ্টি তাদের সরাতে পারেনি বিমানবন্দর থেকে। সাড়ে ছ’বছর পর দেশের মাটিতে পা দিয়েই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নির্বাসিত প্রবাস জীবন কাটাতে হয় আজকের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সেই সময়ে ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামি লিগের কাউন্সিলে দলের নেতারা শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করেন। দেশে ফেরার পর তিনি দায়িত্ব নেন আওয়ামি লিগের। দেশে ফেরার প্রথম দিনেই শেখ হাসিনা ছুটে গিয়েছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে, যেখানে ঘাতকরা হত্যা করেছিল তাঁর বাবা শেখ মুজিবুর রহমান, মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল আর দুই ভাইয়ের স্ত্রীকে। তবে তৎকালীন জিয়াউর রহমানের সরকার তাঁকে সে দিন ঢুকতে দেয়নি স্বজনের রক্তে ভেজা সেই বাড়িতে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ে ফিরে যেতে হয়েছিল তাঁকে। সে দিন শেখ হাসিনার চোখের জল আর বৃষ্টির জলে একাকার হয়ে ভিজেছিল বাংলাদেশের মাটি।
বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল সায়েম জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সায়েমকে পদত্যাগ করিয়ে রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিতর্কিত এ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসন পায়। সেই সংসদেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ-সহ সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। এক দিকে আইনি সুরক্ষা দিয়েই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের পথ বন্ধ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।
১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামি লিগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করতে ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর সংসদে ইনডেমিনিটি আইন বাতিল করা হয়৷ ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর আবাসিক একান্ত সহকারি (পিএ) মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর দায়ের করেন৷ ৩ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হলে তারা মামলার তদন্ত শুরু করে। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারী সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে৷ ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজি গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন৷ তবে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে থেমে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামি লিগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর গতি ফেরে মামলায়। উচ্চ আদালতে ২৯ দিন শুনানির পর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর ঘোষণা হয় সেই ঐতিহাসিক রায়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ হাইকোর্টের দেওয়া রায়, পঁচাত্তরের ১৫ অগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা মামলায় ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন আহমদ, বজলুল হুদা এবং ল্যান্সার এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
অন্য দিকে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের ৬ জন এখনও বিদেশে পলাতক। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য, যুক্তরাষ্ট্রে আছেন রাশেদ চৌধুরী এবং রিসালদার মোসলেমউদ্দিন। নূর চৌধুরী আছেন কানাডায়। অন্য ঘাতক খন্দকার আব্দুর রশিদ লিবিয়া অথবা কেনিয়ায়, শরিফুল হক ডালিম পাকিস্তান এবং আব্দুল মাজেদ ভারতে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কিছু দিন আগে জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের গ্রেফতারে রেড অ্যালার্ট এখনও বহাল। খুনীদের অবস্থান নিশ্চিত করে দ্রুত তাদের দেশে আনা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল শতভাগ রাজনৈতিক চেতনার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের যে শপথ ছিল, সেই শপথের পথ থেকে মাঝে অনেকটাই বেপথু হয়েছিল বাংলাদেশ। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা লড়ছেন মুক্তিযুদ্ধের পথে দেশটি আনতে, আর সে কারণেই ২০০৪-এর ২১ অগস্ট-সহ ২৩ বারের বেশি তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। পিতা বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন আর শপথ নিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁর কন্যা এখন বাবার সেই স্বপ্নের পথেই ধাবমান করছেন ২০১৯ এর বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার নিজস্ব পরিচয়ে বিশ্বসভায় উজ্জ্বল। দেশটির সব ঔজ্জ্বল্য আর সাহসের ভিত্তি একটিই নামের উচ্চারণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।