হামলার পর।
লন্ডনে জঙ্গি হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করল সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। আইএস ঘনিষ্ঠ একটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তারাই ওই হামলা চালিয়েছে। ও দিকে, লন্ডনে হামলার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
লন্ডন পুলিশের সন্ত্রাসদমন বিভাগের শীর্ষ স্তরের অফিসার মার্ক রাউলি বৃহস্পতিবার সকালে বলেন, ‘‘বার্মিংহাম ও লন্ডনের ৬টি জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা সকলেই কোনও মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সদস্য বা তার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে জড়িত বলে মনে হচ্ছে। জঙ্গি হামলায় মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। আহতের সংখ্যা অন্তত ৪০।
লন্ডন পুলিশ জানিয়েছে, পার্লামেন্ট ভবনে হামলা চালিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় এক নিরাপত্তারক্ষী পথ আটকালে জঙ্গিটি তাকে ছুরি মারে। সেখানেই মৃত্যু হয় নিরাপত্তারক্ষীটির। এর পর পুলিশ গুলি চালালে জঙ্গিটিও পাল্টা গুলি চালায়। তাতে মৃত্যু হয় এক পথচারীর। এর পর পুলিশের গুলিতে জঙ্গিটি নিহত হয়। ওই ঘটনার পরেই থমথমে হয়ে যায় গোটা পার্লামেন্ট চত্বর। সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এমপি-রা। তাঁদের দ্রুত ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে ও পুলিশের সদর দফতরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ দিন অবশ্য কড়া নিরাপত্তায় শুরু হয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশন। ডাউনিং স্ট্রিটে তাঁর বাসভবনের বাইরে ডাকা এক জরুরি ক্যাবিনেট বৈঠকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে চূড়ান্ত পর্যায়ের অ্যালার্ট জারির ঘোষণা করেছেন। এ দিন লন্ডন পুলিশের নতুন সদর দফতর উদ্বোধনের কথা ছিল রানি এলিজাবেথের। রানি তা স্থগিত রেখেছেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বৃহস্পতিবার ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে ব্রিটেনের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন।
আরও পড়ুন-ব্রাসেলস হামলার মুখ নিধি ফের উড়তে চান
বিগ বেনের কাঁটায় তখন দুপুর দু’টো চল্লিশ। টেমসের দু’পারে পর্যটকদের ভিড়। পুরোদমে চলছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশন। হঠাৎই ওয়েস্টমিনস্টার সেতুর ওপর দিয়ে একটা কালো গাড়ি ছুটে এসে পিষে দিল বেশ কিছু মানুষকে। ধাক্কায় টেমস নদীতেই ছিটকে পড়লেন এক মহিলা। তারপর পার্লামেন্ট ভবনের রেলিংয়ে ধাক্কা মেরে থেমে গেল গাড়িটি। লম্বা ছুরি হাতে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল চালক। পার্লামেন্ট চত্বরে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেখানে মোতায়েন পুলিশের ওপর। পুলিশের পাল্টা গুলিতে তখনই নিহত হয় সে। ব্রাসেলস হামলার বর্ষপূর্তিতে নিসের হানার স্মৃতি উস্কে দিল আজ দুপুরের এই হামলা। কোনও গোষ্ঠী এখনও পর্যন্ত যার দায় না-নিলেও একে জঙ্গি হামলাই বলছে পুলিশ। ঘটনায় এক পুলিশ ও আততায়ী-সহ নিহত এখনও পর্যন্ত ৫। আহত অন্তত ৪০। আহতদের এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জখমদের মধ্যে ফ্রান্স থেকে আসা এক দল স্কুলপড়ুয়া রয়েছে বলে খবর। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, নিহত আততায়ী এশীয়। বয়স মধ্য চল্লিশ। মুহূর্তে পার্লামেন্ট চত্বর, ওয়েস্টমিনস্টার সেতু-সহ গোটা এলাকার দখলে নিয়ে নেয় নিরাপত্তাবাহিনী। স্থগিত রাখা হয় নিম্ন কক্ষ হাউস অব কমন্সের অধিবেশন। প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে তখন পার্লামেন্টেই ছিলেন। একটি গাড়িতে করে তাঁকে কোনও অজ্ঞাত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যান দেহরক্ষীরা। ঘটনার সময়ে পার্লামেন্টে প্রায় দু’শো জন এমপি ছিলেন। পার্লামেন্ট লক ডাউন করে তাঁদের পার্লামেন্ট ভবনের মধ্যেই থাকতে বলা হয়। পরে লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের নেতা টিম ফ্যারন-সহ কয়েক জন রাজনীতিককে লন্ডন পুলিশের সদর দফতর নিউ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা কমিটির বিশেষ বৈঠক ডাকা হয়েছে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাসভবন বাকিংহাম প্যালেস পার্লামেন্ট চত্বর থেকে খুব দূরে নয়। হামলার কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রাসাদের সব ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। শহরের এই এলাকাটি পর্যটকদের সব থেকে পছন্দের। বহু পার্ক ও পর্যটনস্থল রয়েছে এখানে। সেই সব জায়গায় সন্ধে পর্যন্ত কয়েক শো মানুষ আটকে রয়েছেন বলে খবর। এলাকাটি আপাতত পুলিশ ও অ্যাম্বুল্যান্সের দখলে। হামলার পরেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল টেমস তীরের সুবিশাল নাগরদোলা ‘লন্ডন আই’। মাঝ আকাশেই আটকে পড়েছিলেন পর্যটকেরা। কিছু ক্ষণ বাদে অবশ্য সকলকে নামিয়ে আনা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ওয়েস্টমিনস্টার-সহ এলাকার সব আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন।
লন্ডনে এই হানা ভারতের সংসদ ভবনে হামলার কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছে অনেকের। আবার ওয়েস্টমিনস্টার সেতুর উপরে গাড়ি দিয়ে পিষে দেওয়ার ঘটনার সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে নিস, মিউনিখ, জেরুজালেমে আইএস জঙ্গি হানার। আপাতত গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে ‘লোন উল্ফ’ হানা। এই ধরনের হামলার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটে জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রচারেও প্রভাবিত হয়ে হামলা চালায় অনেকে। দেশে-দেশে এমন ‘অনুগামী’ তৈরিতে হাত পাকিয়েছে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস।
লন্ডনে হামলায় কোনও ভারতীয় হতাহত হননি বলে জানিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বিদেশ মন্ত্রক। টেরেসা মে প্রশাসনের তরফে এই হামলার কথা জানানো হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। গত কালই আমেরিকা ও ব্রিটেন একযোগে মুসলিমপ্রধান কয়েকটি দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রীদের ইলেকট্রনিক গ্যাজেট হাত-ব্যাগে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল। কারণ হিসেবে তারা সম্ভাব্য জঙ্গি হানার দিকেই ইঙ্গিত করে। লন্ডনের দুপুর প্রমাণ করল কোনও নিষেধাজ্ঞাই হামলা আটকাতে পারে না।