আঙ্কারার আর্ট গ্যালারিতে তখন তাণ্ডব চালাচ্ছে ঘাতক। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন আন্দ্রেই কারলোভ। ছবি: রয়টার্স।
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার কাগদাস সানাত মেরকেজি আর্ট গ্যালারি। রাশিয়ার গ্রামীণ জীবন নিয়ে তুরস্কের বেশ কয়েক জন আলোকচিত্রীর প্রদর্শনী চলছে। সেখানে প্রদর্শনীটি নিয়ে কিছু কথা বলতে শুরু করে ছিলেন রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কারলোভ। ২০১৩ থেকে তিনি তুরস্কে রাষ্ট্রদূতের কাজ সামলাচ্ছিলেন। কূটনীতিক হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। ঠিক তাঁর পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল কালো স্যুট পরা এক ব্যক্তি। দেখে মনে হচ্ছিল পুলিশের লোক। এর পরেই সব পাল্টে গেল। পিছন থেকে কারলোভের উপরে সরাসরি গুলি চালাল সেই ব্যক্তি। লুটিয়ে পরলেন কারলোভ। তার পরে ঘাতকে চিৎকার করে বলতে থাকল, ‘আল্লা হু আকবর, আলেপ্পোকে ভুলবে না! সিরিয়াকে ভুলবে না! আলেপ্পোকে ভুলবে না! সিরিয়াকে ভুলবে না!’ তাকে জীবিত অবস্থায় এখানে থেকে সরানো যাবে না বলেও জানায় ঘাতক। বেশ কিছু ছবিও ভেঙে দেয় ঘাতক। এর পরে নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে নিহত হয় সে। পুরোটাই ধরা পড়ে টিভি ক্যামেরায়। পরে জানা যায়, ঘাতকের নাম মেভলুত মের্ত আলতিনতাস। ১৯৯৪-এ তুরস্কের আইদিন প্রদেশের সোকে শহরে জন্ম। সে পুলিশেরই লোক। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আলতিনতাসেক সে দিন ডিউটি ছিল না। এর ফলে আবার তুরস্ক-রাশিয়ার নড়বড় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। আবার কারণ সিরিয়া। আজ, মঙ্গলবারই মস্কোয় রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের বিদেশমন্ত্রীদের সিরিয়া নিয়ে আলোচনায় বসার কথা।
রাষ্ট্রদূতের মৃত্যু সংবাদ আসার পরে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ‘‘রাশিয়া ও তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা এবং সিরিয়ার শান্তি আলোচনাকে আঘাত করার উদ্দেশে এই হামলা করা হয়েছে। আমাদের একমাত্র জবাব হবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই আরও তীব্র করা এবং দুষ্কৃতীরা তা টের পেতে চলেছে।’’ প্রায় একই কথা জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানও। তিনি জানান, আততায়ী দু’দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে এই কাজ করেছে। এই ঘটনার পরেও তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে নির্ধারিত আলোচনা বাতিল হবে না।
আঙ্কারার আর্ট গ্যালারিতে বক্তব্য রাখছেন রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কারলোভ। অতর্কিতে আক্রমণ চালায় বন্দুকবাজ। ছবি: রয়টার্স।
গত বছরের নভেম্বরে তুরস্কের আকাশে ঢোকার অভিযোগে রাশিয়ার বায়ু সেনার সুখোই-২৪ বিমানটিকে ধ্বংস করে তুরস্কের বায়ু সেনার এফ-১৬ বিমান। এর পরেই দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। ইউকি লিকসের ফাংস করা তথ্যে জানা গিয়েছিল তুরস্কের আকাশসীমায় মাত্র ১৭ সেকেন্ড ছিল সুকোই বিমানটি। এর পরে তুরস্কের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকিও দেয় রাশিয়া। তুরস্কের আসা প্রাকৃতিক জ্বালানী গ্যাসের ৬০ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। তুরস্ক থেকে রাশিয়া মোট কৃষিজাত পণ্যের আমদানির চার শতাংশ আসে। দু’টিই বন্ধ করার কথা ওঠে।
আরও পড়ুন: আঙ্কারায় হত রুশ রাষ্ট্রদূত
এরদোয়ানের পক্ষেই সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। ২০১৬-এ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে ক্ষমতা থেকে সরাতে সেনা অভ্যূত্থান হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, এরদোয়ান অতিরিক্ত ইসলামিক ঝোঁক তুরস্কের সমাজে অস্থিরতা বাড়াচ্ছিল। কিন্তু অভ্যূত্থান ব্যর্থ হয়। ক্ষমতায় ফিরে কঠোর দমন নীতি গ্রহণ করেন এরদোয়ান। সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের অভিযোগও ওঠে। এরদোয়ানের নীতি নিয়ে প্রবল সমালোচনাও হয়। এই সময়েই রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা শুরু করেন এরদোয়ান। চলতি বছরের প্রথম দিকে সুকোই ধ্বংস করার জন্য রাশিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল তুরস্ক। উত্তর সিরিয়ায় আইএস জঙ্গিদের সঙ্গে বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার আগে রাশিয়ার অনুমতি নিয়েছিল তুরস্ক। বেশ কয়েকটি আইএস ঘাঁটির দখল নেয় তুরস্কের সেনা। এরদোয়ান ও পুতিন এর পরে ফোনে মাঝেমধ্যেই কথা হত। সোমবারের ঘটনার পরেও তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছে বলে শোনা গিয়েছে।
দু’দেশের মধ্যে বিরোধের কারণই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে দু’পক্ষ পরস্পর বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। রাশিয়া প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের পক্ষে নেয়। এবং তাঁকে ক্ষমতায় রাখতে নিজের সেনাকে যুদ্ধে নামায়। অন্য দিকে আসাদ বিরোধী অবস্থানে অনড় তুরস্ক। তুরস্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আসাদ বিরোধীদের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য নিজের সীমান্ত খুলে রেখেছিল তুরস্ক। এর ফলে সুবিধা পেয়ে যায় ইসলামিক স্টেট-ও (আইএস)। তুরস্ক হয়ে রসদ ও বিদেশী জঙ্গিদের সিরিয়ায় ঢোকা সহজ হয়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি সেই সীমান্তে কড়াকড়ি শুরু করেছে তুরস্ক। ফলে বিদেশী জঙ্গি সরবরাহে টান পড়েছে আইএস-এর।
আন্দ্রেই কারলোভের উপর গুলি চালানোর মুহূর্ত-
সম্প্রতি রাশিয়ার সেনার সাহায্যে আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীদের অন্যতম ঘাঁটি আলেপ্পো দখল করেছে সিরিয়ার বাসার আল-আসাদ অনুঘত সেনা। প্রায় চার বছরের যুদ্ধে আলেপ্পো প্রায় শ্মশানে পরিণত হয়েছে। আলেপ্পোর পতনের পরে রাশিয়ার ভূমিকার সমালোচনা করেছিলেন এরদোয়ান। আলেপ্পোয় মানবাধিকারের উলঙ্ঘন নিয়েও সরব হন এরদোয়ান। তার পরে সোমবারের ঘটনা। আলেপ্পো থেকে বন্দি, আর্ত নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার নাগরিককে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেবই বলছে প্রায় ৫০ হাজার নাগরিক আলেপ্পোর বিদ্রোহীদের অধিকারে থাকে অঞ্চলে আটকে ছিলেন। অনেকের মতে সংখ্যাটা আরও বেশি। নানা চাপান-উতোরে মাঝেমধ্যেই এই সরিয়ে নেওয়ার পক্রিয়াটি ধাক্কা খাচ্ছে। এই ঘটনার পরে অনেক আশঙ্কা পরিস্থিতির অবনিত হতে পারে। পাশপাশি রাশিয়া সামরিক ভাবে নতুন কোনও ব্যবস্থা নিতে পারে বলেও আশঙ্কা। পুতিনের টেলিভিশন বার্তার মধ্যে সেই আশঙ্কা লুকিয়ে আছে বলে অনেকের সন্দেহ।