যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন। ফাইল চিত্র।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে প্রাণ হাতে করে কলকাতা পালিয়ে গিয়েছিলাম। গত বছরের ৫ মার্চ অনেক আশঙ্কা, ভয় নিয়ে কলকাতায় পৌঁছই। তবে ১৫ নভেম্বর ফিরে এসেছি ইউক্রেনে।
এ দেশে ফিরে আসতেও অনেক কসরত করতে হয়েছে। সরাসরি পৌঁছনোর তো এখন কোনও উপায় নেই। প্রথমে কলকাতা থেকে দিল্লি। তার পরে দিল্লি থেকে ইস্তানবুল। সেখান থেকে মলডোভা। তারও পরে সীমান্ত পেরিয়ে ইউক্রেন।
আমি ইউক্রেনে ডাক্তারি পড়ছি। টার্নোপিল ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। বড় হয়ে উঠেছি হাওড়ার বালিতে। পড়তে এসে পশ্চিম ইউক্রেনের এই টার্নোপিল শহরেই থাকতে শুরু করি। সৌভাগ্যক্রমে এই শহরের পরিবেশ এখন অনেকটাই শান্ত, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সরাসরি টার্নোপিল শহর এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বাকি শহরগুলোর মতো যুদ্ধের ভয়ঙ্কর, প্রত্যক্ষ প্রভাব এখানে নেই। তবু দেশে যে একটা যুদ্ধ চলছে, সেটা এই শান্ত শহরে বসেও বোঝা যাচ্ছে ঠিকই।
যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে পড়েছিলাম আমরা! যুদ্ধ, গোলাগুলি, ধ্বংসস্তূপ, মৃতদেহ— এ সবের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছিল সংবাদমাধ্যমের খবর, ছবি বা ভিডিয়োয়। দেখছিলাম, দেশটার বড় বড় বাড়িঘর-ইমারত কী ভাবে বোমার আঘাতে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। শান্ত টার্নোপিলের পরিবেশও আচমকা বদলে গিয়েছিল। দিনের পর দিন কাটছিল ভয় আর অনিশ্চয়তায়। প্রাণটুকু নিয়ে দেশে ফিরতে পেরেই তখন নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। এখন আবার ইউক্রেনে যখন এলাম, তখন অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে।
খুব বেশি দিন নয়, বছরখানেক আগের কথাই ধরা যাক। আগে এই শহরে রাতে দেখতাম দশটা-এগারোটা অবধি রাস্তাঘাটে লোকজন ঘোরাফেরা করছে। রাস্তাগুলো আলোয় ভরে থাকত। কিন্তু এখন সন্ধে সাতটার পরে আর ঘর থেকে বাইরে বেরোনোর অনুমতি নেই এই শহরে। রাস্তার আলোগুলোও নিভে যায়— শহরের প্রাণের মতো।
যদিও যুদ্ধের পরেও এখানে জিনিসপত্রের দাম সেই তুলনায় খুব বেশি বাড়েনি। বিলাসদ্রব্যের দাম অবশ্য অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়লেও সেটা তেমন বেশি কিছু নয়।
তবে একটা কথা বলতেই হয়। এখানকার মানুষগুলোকে দেখে খারাপ লাগছে। এঁরা সকলেই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন জায়গা থেকে এই শহরে এসে জড়ো হয়েছেন। খুব সমস্যার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। নিজেদের বাড়িঘর নেই। যেমন, বহু পরিবার ছোট বাচ্চা নিয়ে আমাদের মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসের ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। তার পরেও এঁরা মানসিক ভাবে ভীষণ শক্ত। যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন, তার সঙ্গে ভালবেসে থেকে যাবেন, মনোভাব অনেকটা এ রকম।
আর হ্যাঁ, আরও একটা কথা। পড়াশোনা শেষ করতে আমার কোনও কোনও বন্ধুও আবার ফিরে আসছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে। অবশ্য ফেরেননি, এমনও অনেকে আছেন। কেউ কেউ বদলি নিয়ে নিয়েছেন। ভেবেছেন, হয়তো ভারতেই ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পাবেন। তবে আমি নিজে কখনওই ডাক্তারি পড়া শেষ করার জন্য ভারতে ফিরে যেতে চাইনি। সেটা সম্ভবও ছিল না। ওখানকার পড়ুয়ারাই আসন ফাঁকা পাচ্ছেন না, আবার আমরা কোথা থেকে ফিরে গিয়ে সুযোগ পাব! প্রথম দিন থেকেই আমি চেয়েছি ইউক্রেনে ফিরে আসতে— যা-ই হয়ে যাক না কেন। যদিও মা-বাবা আমায় নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় ছিল। কিন্তু এই জায়গাটা আমার সন্তানের মতো। শহরটার কথা ভীষণ, ভীষণ মনে পড়েছে, দেশে ফিরে যাওয়ার পুরোটা সময় ধরেই।
তাই শেষ পর্যন্ত আমি খুব খুশি যে, এখানে ফিরে আসতে পেরেছি। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও আমাদের কোনও ক্ষতি হয়নি। কারণ, শিক্ষকেরা বাঙ্কার থেকেও আমাদের ক্লাস করিয়ে গিয়েছেন নিয়মিত। এক দিনের জন্যও পড়ানো বন্ধ রাখেননি। এখানে নিয়ম, সাইরেন বাজলেই বাঙ্কারে যেতে হবে। তাই সরাসরি যুদ্ধের আঁচ এই শহরে না লাগলেও বাঙ্কারে বসে ক্লাস হয়েছে আমাদের। এখন আমরা এখানে অফলাইন ক্লাস করছি রোজ। প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসও চলছে। যে সময়ে আমার ডাক্তারি পাশের ডিগ্রি পাওয়ার কথা ছিল, সেই সময়েই পাব। যুদ্ধের জন্য আমার কোনও বছর নষ্ট হচ্ছে না। যুদ্ধ অনেক কিছু পাল্টালেও এই স্বাভাবিক ছন্দগুলো ভাল লাগছে।
যে কথা বলছিলাম, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ভারতীয় পড়ুয়াই ইউক্রেনে ফিরে এসেছেন। পড়াশোনা শুরু হয়ে গিয়েছে। রোজ আরও অনেক ভারতীয় পড়ুয়া ফিরে আসছেন। পড়াশোনার জন্য আবার এ দেশে থাকার কথা ভাবছেন। এই সপ্তাহেই যেমন আমার চার জন বন্ধু ইউক্রেনে ফিরে আসছে ভারত থেকে।
তবে ভয় করে, যখন সাইরেন বাজে। সাইরেনের শব্দটা ভয়ানক আতঙ্কের। এখন যদিও শব্দটার সঙ্গে বাঁচার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও বিদ্যুৎ চলে যায় প্রায় দশ ঘণ্টার জন্য। কখনও একাই পড়াশোনা চালিয়ে যাই। দিনের শেষেপরিস্থিতি যা-ই থাকুক, মানিয়ে নিচ্ছি। কারণ দিনের শেষে দেশটাকে ভালবেসে ফেলেছি। ইউক্রেনের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। জীবনে প্রথম বার তুষারপাত দেখা তো এখানে এসেই। যে দেশটা আমায় আমার স্বপ্নের দিকে একটু একটু করেএগিয়ে নিয়ে চলেছে, সেই দেশ ছেড়ে যাব কী করে!
অনুলিখন: চৈতালি বিশ্বাস