রাশিয়ার গোলাবর্ষণে জখম হয়েছেন এই অন্তঃসত্ত্বা। মারিয়ুপোলের হাসপাতাল থেকে তাঁকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পিটিআই
যেন রক্তে ধোওয়া হয়েছে হাসপাতালের বেড। শয্যা লাগোয়া জানলার ভাঙা কাচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে চারপাশে। হাওয়ায় উড়ছে পোড়া ছাই আর মৃত্যুভয়।
গত কাল রাতে ইউক্রেনের মারিয়ুপোলের শিশু ও প্রসূতি হাসপাতালে হামলা চালায় রুশ বাহিনী। গোটা বাড়িটার একটা ঘরও আস্ত আছে কি না সন্দেহ। সামনের মাঠে রাতারাতি প্রায় ১৮ ফুট গভীর গহ্বর তৈরি হয়েছে। ওখানে পড়েছিল রাশিয়ার বোমা। ইউক্রেনের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম মারফত এই হাসপাতালে হামলার একের পর এক ভিডিয়ো ফুটেজ দিনভর ভেসে উঠেছে টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। মস্কোর নিন্দায় সরব আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি-সহ বহু দেশ। ‘চরম বর্বরতা’ বলে ক্ষোভ উগরে দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। রাশিয়ার অবশ্য দাবি, ‘সব ভুয়ো খবর’। তাদের ব্যাখ্যা, ওই বাড়িটিতে আগে হাসপাতাল ছিল। বহু দিন আগেই ওই জায়গার দখল নিয়েছে তারা। রাষ্ট্রপুঞ্জে রাশিয়া সরকারের প্রতিনিধি দিমিত্রি পোলানস্কি বরং জোর দিয়ে বলেছেন, ‘‘এ ভাবেই ভুয়ো খবরের জন্ম হয়।’’
মস্কোর দাবি উড়িয়ে দিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি বলেন, ‘‘যেমন ওরা সবসময় দৃঢ়তার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলে থাকেন।’’ মারিয়ুপোলের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি এ-ও বলেন, ‘‘রাশিয়া আমাদের দেশে গণহত্যা চালাচ্ছে। এটা কী রকম দেশ, কেমন রুশ ফেডারেশন, হাসপাতালেও ওদের ভয়? প্রসূতি হাসপাতালেও ওরা ভয় পাচ্ছে, তাই ধ্বংস করে দিতে হল? রুশপন্থী ডনেৎস্ক বা লুহানস্ক অঞ্চলের কোনও শহরে আমরা কখনও এমন কাজ করিনি, কোনও দিন করবও না। কোনও অঞ্চলেই করব না। আমরা মানুষ। কিন্তু উনি কী?’’ প্রেসিডেন্ট নিজেই কিছু ভিডিয়ো ফুটেজ পোস্ট করেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাতে দেখা গিয়েছে হাসপাতালে ভিতরের অবস্থা। ঘরের ছাদ ভেঙে পড়েছে, ঝলসে গিয়েছে দেওয়াল, জানলা-দরজা ভাঙা, ...যেন ভগ্নস্তূপ। জ়েলেনস্কি বলেন, ‘‘এর নীচে কত জন চাপা পড়ে আছে, জানি না।’’ সরকারি ভাবেও কিভের তরফে ঘোষণা করা হয়েছে, নিহতের সংখ্যা এখনও স্পষ্ট নয়। অন্তত ১৭ জন কর্মী জখম হয়েছেন। বহু ভিডিয়ো ফুটেজে দেখা গিয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি সন্তানকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মায়েরা। খুদে রোগীদের অনেকেই গুরুতর জখম। হাসপাতালের বাইরে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে তাদের। রাশিয়া অবশ্য বলেই চলেছে, ‘‘সব ভুয়ো খবর।’’
এ প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) আজ জানিয়েছে, শুধু মারিয়ুপোলের হাসপাতাল নয়, ইউক্রেনের একাধিক হাসপাতাল, অ্যাম্বুল্যান্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরে হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী। তাদের দাবি, এমন অন্তত ১৮টি স্বাস্থ্য পরিষেবামূলক ব্যবস্থার উপরে আঘাত হেনেছে মস্কো। হু-র ইউরোপ শাখার প্রধান মাইক রায়ান আজ বলেন, ‘‘কোভিড ছড়াবে, নাকি পোলিয়ো দেখা দেবে, নাকি হাম... এ সব নিয়ে বলছি না। কিন্তু সার্বিক ভাবে দেখলে, লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায় অবস্থায় রয়েছেন, তাঁরা পালাতে চাইছেন, মাটির নীচে বেসমেন্টে বদ্ধ অন্ধকার কুঠুরির মধ্যে চাপাচাপি করে রয়েছেন অনেক মহিলা ও শিশু, মানুষ ক্লান্ত, তাঁদের খাবার জুটছে না, তাঁরা ঘুমোতে পারছেন না, এতে সকলের শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে। এ অবস্থায় গোটা দেশে ভয়ানক সংক্রামক রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়তে পারে।’’ কোভিড অতিমারির রেশ এখনও কাটেনি। রায়ান বলেন, ‘‘ফের কোনও মহামারির আসা রুখতে হলে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা প্রয়োজন।’’
তবে সে সম্ভাবনার দেখা নেই এখনও। আজ ইউক্রেন ও রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠক বসেছিল তুরস্কে। এর আগে বেলারুস সীমান্তে তিনটি শান্তি বৈঠক হয়ে গিয়েছে। আজকের বৈঠকেও যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনও লিখিত চুক্তিতে পৌঁছতে পারেনি দু’পক্ষ। টানা ২৪ ঘণ্টার জন্য যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়েছিল ইউক্রেন। তাতে রাজি হয়নি রাশিয়া। বৈঠক শেষে ইউক্রেনের বিদেশমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা বলেন, ‘‘মনে হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ওঁর নেই।’’ তুরস্কের বিদেশমন্ত্রী মেভলুত চাভুশোগলু জানান, বৈঠকের একটি ফলাফল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ, দু’দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে কথা শুরু হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘একবার বৈঠকেই মিরাকল ঘটে যাবে, এ রকম আশা করাটাও ঠিক নয়।’’
আজ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে একযোগে ফোন করেছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ় এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করার দাবি জানান দু’জনেই। একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, পুতিনকে তাঁরা এ-ও বলেছেন, যুদ্ধে কিছু পেতে হলে মস্কো ও কিভ, দু’পক্ষকেই সমঝোতা করতে হবে। যদিও তাঁদের এই পরামর্শে পুতিনের মন বদলেছেন বলে মনে হয় না। মারিয়ুপোলে ফের হামলা শুরু করেছে রাশিয়া।
রাশিয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি ক্রমশ বাড়ছে। এর পাশাপাশি যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি তো রয়েইছে। কিভ আজ দাবি করেছে, তাদের হামলায় ১২ হাজার রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। রাশিয়ার ৪৯টি যুদ্ধবিমান, ৩৩৫টি ট্যাঙ্ক, ৮১টি হেলিকপ্টার এবং আরও অসংখ্য যুদ্ধাস্ত্র ধ্বংস করেছে তারা। ক্রেমলিন জানিয়েছে, মারাত্মক চাপের মধ্যে রয়েছে রুশ অর্থনীতি।
রাশিয়া থেকে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা আমদানি করা হবে কি না, তা নিয়ে আজ আমেরিকান হাউসে ভোটাভুটি হয়েছিল। মস্কোর উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপানোতেই ভোট পড়েছে বেশি। সে ক্ষেত্রে হয়তো এ বার মস্কোর থেকে তেল কেনাও বন্ধ করবে ওয়াশিংটন। একের পর এক নিষেধাজ্ঞায় কোণঠাসা রাশিয়া। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকোভ আজ বলেন, ‘‘প্রচণ্ড ধাক্কা খাচ্ছে আমাদের অর্থনীতি। আগে কখনও রাশিয়ায় এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এর পর কী হবে, এখন থেকে তার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এর নেতিবাচক প্রভাব তো অবশ্যই পড়বে।’’