গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
জ্বলছে গোটা ইউক্রেন। রাশিয়ার হাতে চলে গিয়েছে বন্দর-শহর খারসেন। আজভ সাগরের তীরে কৌশলগত ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মারিউপোল বন্দরও ঘিরে ফেলেছে তারা। ওখতিরকা, কিভ, খারকিভের মতো শহরগুলোতে লাগাতার গোলাবর্ষণ চলছে। ইউক্রেনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ওডেসাও রুশদের হাতে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।
যুদ্ধের আট দিনের মাথায় আরও বিধ্বংসী রাশিয়া। এর মধ্যেই আজ বেলারুস সীমান্তে বসল দ্বিতীয় পর্যায়ের শান্তি বৈঠক। দু’দেশই সহমত প্রকাশ করল, যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে আটকে পড়া সাধারণ মানুষদের উদ্ধারের পথ করে দেওয়া হবে। বৈঠকে ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার দাবিও জানিয়েছিলেন। তার জবাব মেলেনি। এ দিনের বৈঠকের পরে যদিও দুই দেশের তরফেই মধ্যস্থতাকারীরা জানিয়েছেন, খুব শীঘ্রই তৃতীয় দফার বৈঠক বসবে। সুনির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি ধরেই বৈঠক এগোচ্ছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অবশ্য দিনের শুরুতেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, যুদ্ধ চলবে। ক্রেমলিন তার লক্ষ্য পূরণ করেই ছাড়বে। এই ক’দিনেই দেশটাকে আর চেনা দায়। ইঁট-কাঠ-পাথরের ধ্বংসস্তূপ। কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বহুতলগুলো। একটানা বেজে চলেছে উদ্ধারকারী গাড়ির সাইরেন। আর মাঝেমাঝেই সে সব ছাপিয়ে বিস্ফোরণে শব্দ। অভিযোগ, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, জনবসতি কিংবা ধর্মীয় স্থান, কিছুই রেয়াত করছে না রুশরা। খারকিভে আজ তিনটি স্কুল ও একটি ক্যাথিড্রালে হামলা চালিয়েছে মস্কোর বাহিনী। কাল রাতে খারকিভের ইজুম এলাকায় গোলাবর্ষণে ৮ জনের প্রাণ গিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দু’টি শিশুও। ওখতিরকা শহরে বহু আবাসনকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে তারা।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের ছবি। ম্যাক্সার প্রযুক্তিতে তোলা ছবিটিতে দেখা গিয়েছে, চেরনিভ অঞ্চলে রিভনোপিলা গ্রামে জ্বলছে ঘরবাড়ি। কিভের ৮০ কিলোমিটার উত্তরে এই গ্রাম। রিভনোপিলার আশপাশের জমিতে ডজনখানেক বিশালাকার গর্ত। রুশদের বোমাবর্ষণের নিদর্শন, যা কি না ধরা পড়েছে উপগ্রহ চিত্রেও। স্ট্রাইঝেন নদীর উপরে সেতুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সামনেই একটা
কারখানা ছিল। ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত সেটিও। কাছের সড়কে রুশ সেনাবাহিনীর কনভয় দেখা গিয়েছে ওই ছবিতে। কিন্তু এই শেষ ছবি। এর পর থেকে উপগ্রহ চিত্রে আর কিছুই দৃশ্যমান নেই। দেশের সর্বত্র ঘন কালো ধোঁয়ায় ঢাকা আকাশ।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি আজ ফের পশ্চিমের কাছে সাহায্যের আর্তি জানান। তিনি বলেন, ‘‘আপনারা যদি আকাশপথ বন্ধ করতে না পারেন, তা হলে আমায় আরও যুদ্ধবিমান দিন! আমরা যদি আর না থাকি, ঈশ্বর না করুন, এর পরের বাজি লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্টোনিয়া ...বিশ্বাস করুন।’’ রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চান জ়েলনস্কি। তাঁর কথায়, ‘‘যুদ্ধ থামানোর এটাই একমাত্র উপায়। আমরা রাশিয়াকে আক্রমণ করছি না। আমাদের তেমন কোনও উদ্দেশ্যও নেই। আপনারা আমাদের থেকে কী চান? আমাদের জমি থেকে চলে যান।’’ এর পরেই ফের তিনি বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে বসে কথা বলুন। তবে ও রকম ৩০ মিটার দূরে নয়।’’ সম্প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন পুতিন। বৈঠকের ছবি প্রকাশ হতে দেখা যায়, এক বিশাল টেবিলের দু’প্রান্তে দু’জনে বসে।
যুদ্ধ শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে আমেরিকা সতর্ক করেছিল ইউক্রেনকে। জানিয়েছিল, মস্কো হামলা করতে পারে। জ়েলেনস্কি সে কথা উড়িয়ে দিয়ে দেশবাসীকে শান্ত থাকতে বলেছিলেন। আজ তিনি সেই প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘‘কেউ ভাবতে পারেনি, আজকের দিনে কোনও মানুষ এমন পাশবিক আচরণ করতে পারেন।’’
ইউক্রেনে এ পর্যন্ত কত মানুষের প্রাণ গিয়েছে, তার কোনও হিসেব নেই। গত কাল সরকার দাবি করেছে, ২ হাজারের বেশি সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। অনেকেরই মতে, আসল সংখ্যাটা বহু গুন বেশি। আজ দিনভর বোমা পড়েছে চেরনিহিভের জনবসতি এলাকায়। ধ্বংসস্তূপ সরাতেই মিলেছে ২২টি দেহ। এমন কত দেহ পড়ে রয়েছে কত জায়গায়। ২০২০ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ইউক্রেনে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের বাস। রাষ্ট্রপুঞ্জের দাবি, অন্তত ৪০ লক্ষ মানুষ দেশছাড়া হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে পালিয়েছেন ১০ লক্ষ ইউক্রেনীয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জানিয়েছে, শরণার্থীদের রক্ষা করতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রোমানিয়ায় তাঁদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল তৈরি করা হবে বলেও শোনা যাচ্ছে।
আজ ইউক্রেন সরকারের তরফেই ঘোষণা করা হয়, দক্ষিণের শহর খারসেনের দখল নিয়েছে রুশ বাহিনী। যুদ্ধের ভয়াবহতা এখন আরও তীব্র। মারিউপোল শহরের কাউন্সিলর জানিয়েছেন, নাগাড়ে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রুশ সেনা। জেনেবুঝে বোমা ফেলা হচ্ছে জনবসতিতে। ক্ষোভ উগরে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘খাবার জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, প্রবল ঠান্ডায় ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা অকেজো, মানুষকে উদ্ধার করে যে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে, তার উপায় নেই!’’
কিভ ও খারকিভের মতো দুই বন্দর শহর ওডেসা ও মারিউপোলকে এখনও দখল করতে পারেনি রাশিয়া। স্থলপথে তা দখল করাও কষ্টসাধ্য। আমেরিকা সতর্ক করেছে, জলপথে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া। তাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ ক্রিমিয়া থেকে ওডেসার দিকে এগোচ্ছে। ওডেসার মেয়র গনাডি ট্রুখানভ দাবি করেছেন, হামলার জবাব দিতে তাঁরাও প্রস্তুত।
রাজধানী কিভের পরিস্থিতিও ক্রমশ জটিল হচ্ছে। তবে তা এখনও ইউক্রেন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। কাল থেকেই শহরের বাইরে জড়ো হয়েছে প্রায় ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সেনা কনভয়। তারা ক্রমশ রাজধানীর দিকে এগোচ্ছে। বর্তমান সরকারকে গদিচ্যুত করাই রাশিয়ার লক্ষ্য।
শোনা যাচ্ছে, ইউক্রেনের গদিতে হয়তো নিজের পছন্দের কোনও ‘পুতুল সরকার’ বসাবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচকে মস্কো নতুন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করতে পারে বলেও শোনা গিয়েছে। জ়েলেনস্কি এখনও কিভের মাটি আঁকড়ে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের আর কিছু হারানোর নেই।’’ কিভের মেয়র ভিটালি ক্লিতশকো জানিয়েছেন, কাল রাত থেকে টানা বিস্ফোরণ ঘটছে। তবে নতুন করে কোনও প্রাণহানি হয়নি। একটি রুশ ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করেছে ইউক্রেনের বায়ুসেনা। তিনটি রুশ যুদ্ধবিমানকেও গুলি করে নামিয়েছে তারা।
‘শত্রুদের’ বিরুদ্ধে লড়তে সাধারণ মানুষের হাতেও অস্ত্র তুলে দিয়েছে জ়েলেনস্কি সরকার। তাতে দেশবাসীর একাংশ ক্ষুব্ধ। তাঁদের অভিযোগ, অবিবেচকের কাজ করেছেন জ়েলেনস্কি। সেনাবাহিনীর হাতে থাকা অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র চলে এসেছে দুষ্কৃতী দলগুলির হাতে। ফলে অবাধে চলছে ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ। গঞ্জালো লিরা নামে এক বাসিন্দা সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেছেন, ‘‘বাধ্য হচ্ছি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে, জ়েলেনস্কির সরকার সত্যিই ক্ষতিকর।’’
সপ্তাহ পেরিয়েছে যুদ্ধের। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা রয়েছে। মাথার উপর ছাদ নেই। খাবার নেই। ভবিষ্যৎ জানা নেই। শরীরের ঘা-জখম নিয়ে ধ্বংসস্তূপে বসে থাকা মানুষগুলোর মনে ক্রমেই জমাট বাঁধছে ক্ষুধা, ক্লান্তি ও হতাশা।