বিজয়ী: নোবেল জয়ের খবর শোনার পরে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গুরু-শিষ্য রবার্ট উইলসন এবং পল মিলগ্রোমের। সোমবার। এএফপি
গুরু-শিষ্যের নোবেলজয়। এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির দুই অর্থনীতিবিদ পল মিলগ্রোম (৭২) ও রবার্ট উইলসন (৮৩)। স্ট্যানফোর্ডেই উইলসনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করেছিলেন মিলগ্রোম।
অকশন থিয়োরি বা নিলাম তত্ত্বে তাঁদের অবদানের জন্যই পুরস্কার, জানিয়েছে নোবেল কমিটি। মানুষ যবে থেকে আর্থিক লেনদেন শুরু করেছে, নিলামের ধারণাও আছে কার্যত তবে থেকেই। কোনও জিনিস বিক্রি করার সময় যে ক্রেতা সবচেয়ে বেশি দাম দিতে রাজি হবেন, তাঁকেই জিনিসটা বেচবেন বিক্রেতা, এটাই চিরকালের নিয়ম। সেই নিলামের পরিসর ক্রমেই বেড়েছে। অর্থশাস্ত্রেও তাই নিরন্তর খোঁজ চলে, নিলামের কোন পদ্ধতি অনুসরণ করলে সবচেয়ে ভাল দাম পাওয়া যেতে পারে পণ্যের।
লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর অর্থনীতির অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটক বললেন, “অর্থনীতির গবেষণার জগতের বাইরে থেকে দেখলে নিলাম তত্ত্ব বেশ রসকষহীন বিষয় মনে হতে পারে। এমনকি এর একটা আপাতনিষ্ঠুর দিক আছে: কবির ভাষায়, নিলেমের ঘরবাড়ি আসবাব— অথবা যা নিলেমের নয়, সে-সব জিনিস বহুকে বঞ্চিত করে দু-জন কি একজন কিনে নিতে পারে। কিন্তু যন্ত্রের উপকারিতা যেমন ব্যবহারকারীর ওপর নির্ভর করে, অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে নিলামের ভূমিকাও সে রকম। চিত্রশিল্প থেকে জমি, মোবাইল ফোনের স্পেকট্রাম থেকে শুরু করে বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি সব ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ আছে। পল মিলগ্রোম ও রবার্ট উইলসনের অবদান হল, অর্থনৈতিক তত্ত্ব ব্যবহার করে দেখানো কোন কোন সম্পদের ক্ষেত্রে কী ধরনের নিলামের নিয়মকানুন প্রবর্তিত হলে সর্বোত্তম ফল পাওয়া যাবে। আমেরিকায় নব্বইয়ের দশকে মোবাইল ফোনের ডিজিটাল স্পেকট্রামের নিলামের কাঠামো এই তত্ত্বের ভিত্তিতে তৈরি হয়।”
মিলগ্রোম আর উইলসনের কাজের তাৎপর্য কী? জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক কৃষ্ণেন্দু ঘোষদস্তিদার বললেন, “অকশন থিয়োরির তত্ত্বে ওঁদের দুর্দান্ত সব কাজ আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, ওঁরাই প্রথম দেখিয়েছিলেন, কী ভাবে নিলাম তত্ত্বকে বাস্তবিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের সময় মিলগ্রোমকে এফসিসি স্পেকট্রাম অকশনের কাঠামো তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার ফলে নিলাম অনেক বেশি লাভজনক হয়েছিল। অতঃপর গোটা দুনিয়ায় অকশন ডিজ়াইনের কাজে ডাক পড়ে তাত্ত্বিকদের। আগে আমলারাই এই কাজ করতেন।”
উইলসন দেখিয়েছিলেন, যেখানে নিলামে ওঠা পণ্যের মূল্যটি অনিশ্চিত, সেখানে ক্রেতারা যে দামকে এই নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য উচিত মনে করেন, নিলামে দর হাঁকেন তার চেয়ে কম। কারণ, তাঁদের মনে সংশয় থাকে, সত্যিই যদি কেনার পর দেখা যায়, পণ্যটির ব্যবহারিক মূল্য সেই দরের চেয়ে কম! এই ‘বিজয়ীর অভিশাপ’ কাটানোর পন্থা বাতলেছেন উইলসন। মিলগ্রোম দেখিয়েছিলেন, ক্রেতাদের মনে পণ্যের একটা ‘প্রাইভেট ভ্যালু’ থাকে। নিলামের প্রক্রিয়ায় যদি ক্রেতারা পরস্পরের ‘প্রাইভেট ভ্যালু’ আঁচ করতে পারেন, তবে বিক্রেতার পক্ষে তুলনায় বেশি দর পাওয়া সম্ভব।
ব্রিটেনের কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের অধ্যাপক প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিলেন, আজ অনলাইন দুনিয়ায় মানুষের ডিজিটাল প্রোফাইলের কেনাবেচা চলে অতি জটিল নিলাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই নিলামের পদ্ধতির সঙ্গে মিলগ্রোম-উইলসনের কাজের প্রত্যক্ষ যোগ নেই বটে, কিন্তু তাঁরা যে অকশ ডিজ়াইনের কাজ আরম্ভ করেছিলেন, এ তারই উত্তরসূরি।