পাকিস্তান নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সময় উচ্ছ্বসিত কিশোর। ছবি: রয়টার্স।
মূলধারার রাজনীতিতেই আস্থা রাখল ভারতের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান। জনতার দরবারে পাত্তা পেল না মৌলবাদী দলগুলি। পাক ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে এখন মোট আসন ৩৩৬। কিন্তু তার মধ্যে সরাসরি ভোট হওয়ার কথা ছিল ২৬৬টি আসনে। কিন্তু এক প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে ২৬৫টি আসনে ভোট হয়েছে। বাকি ৭০টি আসন মহিলা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে।
পাক নির্বাচন কমিশন ‘রাজনৈতিক দল’ হিসাবে পিটিআই-এর স্বীকৃতি বাতিল করায় তারা সরাসরি ভোটের ময়দানে নেই। কিন্তু ইমরানের দলের অনেক নেতাই ‘নির্দল’ হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। নির্বাচনের দু’দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে ফল ঘোষণা করেনি পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন। পাক নির্বাচন কমিশনের ভোটের হিসাব বলছে, এখনও পর্যন্ত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে জয়ী প্রার্থীদের মধ্যে নির্দলেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্য দিকে, এখনও পর্যন্ত নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) ৭১টি এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৫৪টি আসনে এগিয়ে। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে পাকিস্তানের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলিই সরকার গড়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে। অনেকটাই পিছিয়ে জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম এবং জামাত উদ-দাওয়ার মতো মৌলবাদী দলগুলি।
জন্মসূত্রে ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানে ৯৭ শতাংশ ভোটার মুসলিম হলেও ধর্মীয় দলগুলি কোনও দিনই খুব একটা জনসমর্থন পায়নি ভোটে। পাকিস্তান ভাগের আগে ১৯৭০-এ জামাত-ই-ইসলামি পশ্চিম পাকিস্তানে জ়ুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপিপি এবং পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবর রহমানের আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে অনেক প্রার্থী দিয়েছিল। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি আসনে জিততে পেরেছিল। ২০১৮ সালে মুত্তাহিদা মজলিস-এ-আমল গোটা দেশে প্রচুর প্রার্থী দিয়েছিল। কিন্তু জিতেছিল মাত্র ১২টিতে। এ বার কট্টরপন্থী নেতা ফজল উর রহমান একাধিক ছোট দলকে সঙ্গে নিয়ে জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলামের ছাতার তলায় ভোটে লড়তে নেমেছেন। ভোটের লড়াইয়ে রয়েছে ২৬/১১ মুম্বই সন্ত্রাসের মূল চক্রী হাফিজ় সইদের সংগঠন জামাত উদ-দাওয়ার রাজনৈতিক শাখা মারকাজি মুসলিম লিগ। লস্কর-ই-তইবার পাশাপাশি, ‘নিষিদ্ধ’ আরও কয়েকটি জঙ্গিগোষ্ঠী, যেমন, জামাত-উদ-দাওয়া এবং মিল্লি মুসলিম লিগের সদস্যদেরও প্রার্থী করছিল মারকাজি মুসলিম লিগ।
তবে পাক নির্বাচন কমিশনের ফলাফল বলছে, এখনও পর্যন্ত মাত্র তিনটি আসনে এগিয়ে জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম। পাকিস্তানের নির্বাচনে ধাক্কা খেয়েছে হাফিজ়ের দলও। হাফিজ়-পুত্র তালহা হাফিজ় সইদ লাহোরের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরের কেন্দ্র থেকে হেরে গিয়েছেন। ওই কেন্দ্রে জিতেছেন ইমরানের পিটিআই-সমর্থিত লতিফ খোসা। ‘চেয়ার’ প্রতীকে নির্বাচন লড়তে নেমেছিলেন তালহা। তিনি মাত্র ২০২৪টি ভোট পেয়েছেন।
জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা অতীতেও পাকিস্তানে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে মিল্লি মুসলিম লিগ থেকে কয়েক জন লড়তে চেয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত সেই আবেদনে সাড়া দেয়নি কমিশন। মিল্লি মুসলিম লিগের সাত জন সদস্যকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করেছিল আমেরিকা। সেই তালিকায় থাকা চার জনই এ বারের নির্বাচনে মারকাজি মুসলিম লিগের প্রার্থী ছিলেন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়। তবে প্রথম নির্বাচন থেকেই জনগণের দরবারে ধাক্কা খেয়েছে পাকিস্তানের মৌলবাদী দলগুলি। সেই নির্বাচনে জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম পেয়েছিল মাত্র ৭টি আসন। অন্য দু’টি দল জামাত-ই-ইসলামি এবং মারকাজি জমিয়ত উলেমা-ই-পাকিস্তান পেয়েছিল যথাক্রমে ৪টি এবং ৭টি আসন। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে একটিও ভোট পায়নি জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম। এর পর থেকে জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম দল বার বার ভেঙেছে, গড়েছে। অন্য শাখা তৈরি হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে কেউই বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। পাক সাধারণ নির্বাচনে সুবিধা করতে পারেনি অন্য কোনও মৌলবাদী দলও। পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, ২০১৩ সালের নির্বাচনের পর থেকেই বিভিন্ন ধর্মীয়-রাজনৈতিক দলগুলির জনপ্রিয়তা কমেছে। সারা পাকিস্তান জুড়ে তাদের জনপ্রিয়তা ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে যেন তারই প্রতিফলন দেখা গেল।