আদালতের বাইরে বিচারের দাবিতে ধর্না। সোমবার জর্জিয়ায়। রয়টার্স
শান্তি বজায় রাখুন। আহমদ আরবারি হত্যা মামলা শুরু হওয়ার দিনে জর্জিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ-অধ্যুষিত এই শহরে এটাই বার্তা প্রশাসনের। শহরবাসীকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মামলা দেখতে আসা অন্যদেরও।
গত বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণাঙ্গ যুবক, ২৫ বছর বয়সি আহমদ আরবারিকে গুলি করে খুন করেন তিন শ্বেতাঙ্গ। আহমদ তখন জগিং করছিলেন। অভিযুক্তদের প্রথমে গ্রেফতার করেনি স্থানীয় পুলিশ। কিন্তু এই ঘটনার আড়াই মাস পরে আরবারিকে গুলি করার ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ায় নড়েচড়ে বসে তারা। ৭ মে গ্রেফতার করা হয় তিন অভিযুক্ত— ৬৪ বছর বয়সি গ্রেগরি ম্যাকমাইকেল, তাঁর ৩৪ বছরের ছেলে ট্র্যাভিস এবং তাঁদের প্রতিবেশী, ৫০ বছর বয়সি উইলিয়াম ব্রায়ানকে। তিন জনের বিরুদ্ধেই খুনের মামলা রুজু করা হয়। দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁদের আমৃত্যু কারাদণ্ড হতে পারে। আজ মামলার জুরি নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে। সেই প্রক্রিয়া শেষ হলে শুনানি-পর্ব শুরু হবে।
কেন খুন করা হয়েছিল আহমদকে? অন্যতম অভিযুক্ত, প্রাক্তন পুলিশ গ্রেগরি ম্যাকমাইকেল প্রথমে দাবি করেছিলেন, সে সময়ে তাঁদের এলাকায় চুরির ঘটনা খুব বেড়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন বাড়ি থেকে পাওয়া সিকিয়োরিটি ক্যামেরার ভিডিয়ো ফুটেজে দুষ্কৃতীর যে চেহারা স্থানীয়েরা দেখেছিলেন, আহমদকে নাকি সে রকমই দেখতে। জর্জিয়ার তৎকালীন আইন অনুযায়ী, যে কোনও সাধারণ মানুষ এক সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারে। ম্যাকমাইকেলরা আরবারিকে গ্রেফতারই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আরবারি তাঁদের বাধা দেন, এমনকি তাঁদের কিল-চড়ও মারেন। গ্রেগরির কাছে বন্দুক ছিল। ‘আত্মরক্ষা’র জন্যই তিনি গুলি ছোড়েন।
এপ্রিলে আহমদকে গুলির ভিডিয়োটি প্রকাশ্যে এলে দেখা যায়, গ্রেগরির দাবি ঠিক নয়। ভিডিয়োটি তুলেছিলেন অন্যতম অভিযুক্ত উইলিয়াম ব্রায়ান। ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, ফুটপাত ধরে জগিং করছেন আহমদ, আর গাড়িতে চেপে তাঁকে অনুসরণ করছেন বাবা-ছেলে গ্রেগরি ও ট্র্যাভিস। একটু দূরে, আর একটি গাড়িতে, রয়েছেন ব্রায়ান। ভিডিয়োটি তিনিই তুলছেন। অনুসরণ করতে করতে আহমদকে কটূক্তি করে যাচ্ছিলেন গ্রেগরিরা। কিছু ক্ষণ এ রকম চলার পরে গাড়ি থেকে নামেন তিন জনে। আহমদকে ঘিরে ধরেন তাঁরা। চার জনের মধ্যে প্রবল কথা কাটাকাটি হতে থাকে। আহমদকে ধাক্কা মারেন গ্রেগরি। তাঁকে পাল্টা মারার চেষ্টা করে আহমদ। তার পরে গ্রেগরি বন্দুক বার করে পর পর তিন বার আহমদকে গুলি করেন। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন কৃষ্ণাঙ্গ যুবকটি। তখন গাড়িতে উঠে চলে যান বাকি তিন জন।
কিছু ক্ষণের মধ্যে পুলিশ এসে আহমদকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে ময়না-তদন্তে জানা যায়, খুব কাছ থেকে করা দু’টি গুলি আহমদের হৃদ্যন্ত্র এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিয়েছিল। আর একটি গুলি লেগেছিল তাঁর হাতে। ঘটনার সময়ে আহমদ কোনও রকম নেশা করেননি, এ কথাও জানা যায় ময়না-তদন্তে।
আহমদ-হত্যার ভিডিয়োটি প্রকাশ হওয়ার পরে অভিযুক্তদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না, এই অভিযোগে উত্তাল হয়েছিল ব্রুন্সউইক। পরিস্থিতি সামলাতে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরিস্থিতি আরও পাল্টে যায় ২৫ মে-র পরে। মিনিয়াপোলিসে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাঁটুর চাপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান আর এক কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড। নির্বিচারে কৃষ্ণাঙ্গ-হত্যার প্রতিবাদে মুখর হয় গোটা দেশ। সেই আন্দোলনের আঁচ লাগে আহমদ-মামলাতেও। শুধু তাই নয়, এ বছর মে মাসে জর্জিয়ার ‘অ-পুলিশি গ্রেফতার’ আইনটিও বাতিল করে দেওয়া হয়। এই আইন দর্শিয়েই আহমদকে গুলি করেছিলেন ম্যাকমাইকেল। এ বছর আহমদের মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন টুইট করেছিলেন, ‘‘এক জন কৃষ্ণাঙ্গ প্রাণের ভয় না করে জগিং করতে পারবেন, এটাই তো কাম্য!’’
আহমদের বাবা, ৫৮ বছর বয়সি মার্কাস আরবারির কথায়, ‘‘আমার ছেলেকে মারার একটাই কারণ ছিল— সে কৃষ্ণাঙ্গ!’’ আজ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, শুনানির প্রত্যেক দিন আদালতে হাজির থাকবেন। মার্কাস বলেন, ‘‘ধর্মের অনুশাসন আমাকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দিচ্ছে না। কিন্তু আমার ভিতরে প্রচণ্ড রাগ জমা হয়েছে। আশা করব, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।’’
এই মামলা ঘিরে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। আমেরিকার অন্যান্য শহর থেকে মানবাধিকার ও কৃষ্ণাঙ্গ-অধিকার কর্মীরা ভিড় জমিয়েছেন ব্রুন্সউইকে। রয়েছেন অসংখ্য সাংবাদিকও। মামলা-ঘিরে এই উত্তেজনাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন স্থানীয়েরা। এমনই এক জন, থিয়া ব্রুকসের কথায়, ‘‘এঁরা তো মামলা শেষ হলে শহর ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু কালো বা সাদা, আমাদের গায়ের রং যা-ই হোক না কেন, আমাদের এখানেই সবাই মিলে থাকতে হবে। তাই সকলের কাছে আর্জি জানাচ্ছি, আপনারা শান্তি বজায় রাখুন।’’