ছেলে হুসেন-আল-উমারির খোঁজে হন্যে মা।
আবদি ইব্রাহিমের ক্রমশ বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছে যে, তার তিন বছরের ভাইটা আর বেঁচে নেই। হয়তো ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদেরই কোনও কোণায় পড়ে আছে ওর গুলিবিদ্ধ, ছোট্ট শরীরটা। বাবা-মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে গিয়ে নামের তালিকা খুঁটিয়ে দেখেছে ওরা। কই, ভাই মুকাদের নাম তো নেই!
ঘেন্না হচ্ছে আবদির। তীব্র ঘেন্না। ওই লোকটার জন্য, যে গত কাল বন্দুক নিয়ে মসজিদে ঢুকে নাগাড়ে গুলি চালিয়ে লোক মারছিল।
নিউজ়িল্যান্ডের ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম গণহত্যার পরের দিনেও কেউ স্পষ্ট বলতে পারছে না, ঠিক কত মানুষ নিখোঁজ। শুক্রবার মসজিদে প্রার্থনা করতে যাওয়া অনেককেই তাদের পরিবার আর দেখেনি। টুইটারে ভারতীয় হাইকমিশন লিখেছে, ‘‘৭ জন ভারতীয় এবং ২ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূতের খোঁজ মিলছে না।’’ যদিও কেরলের এক যুবতীর নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, তাঁর নাম অংশী কারিপ্পাকুলম (২৭)। এ ছাড়া মহম্মদ জুনেদ কারা (৩৪) নামে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুবকের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম। হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে আরও দুই ভারতীয়ের।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
শুধু ভারত? পাকিস্তানের ৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন গত কাল। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মিশর, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, জর্ডন, নিউজ়িল্যান্ড-সহ বিভিন্ন দেশের নিখোঁজ নাগরিকদের তালিকা বানানো শুরু করেছে রেড ক্রস। কারও পরিবার এখনও আশায়, খোঁজ হয়তো মিলবে। কারও বাবা-মা-ভাইবোনেরা জানিয়েছেন, কঠিন বাস্তবের জন্য নিজেদের তৈরি করছেন তাঁরা।
খোঁজ নেই তিন বছরের মুকাদ ইব্রাহিমের।
৩৩ বছরের আটা এলায়েনের মৃত্যুর খবর যেমন জানিয়ে দিয়েছে সংবাদমাধ্যমেরই একাংশ। মাত্র ক’দিন আগে বাবা হয়েছিলেন আটা। ক্রাইস্টচার্চের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্তার বাইরেও একটা বড় পরিচয় রয়েছে তাঁর। নিউজ়িল্যান্ডের জাতীয় ফুটসল (ছোট, হার্ড কোর্টের ফুটবল) টিমের গোলরক্ষক তিনি। নিউজ়িল্যান্ডের ফুটবল সংস্থা অবশ্য এখনও নিশ্চিত করেনি এই দুঃসংবাদ।
১৪ বছরের সৈয়দ মিলনেও গোলকিপার। ফুটবল আর ফুটসল, দু’টোই খেলত। স্বপ্ন দেখত, নিউজ়িল্যান্ডের জাতীয় দলে খেলবে এক দিন। এ দেশেই জন্ম ওর। কাল বাবা-মায়ের সঙ্গে নমাজ পড়তে গিয়েছিল নুর মসজিদে। হুড়োহুড়ির মধ্যে ওর বাবা শেষ বার দেখেছিলেন, মসজিদের মেঝেতে পড়ে রক্তে ভাসছে ছেলে। সৈয়দের সৎ-দিদি ব্রাইডি বললেন, ‘‘মনটা কু-ডাকছে। অপেক্ষা করছি সবাই।’’
হুসেন-আল-উমরির পরিবারের যেমন একমাত্র আশা, দিনটা পবিত্র ছিল বলেই হয়তো ঈশ্বর ঠিক বাঁচিয়ে নেবেন ৩৩ বছরের যুবককে। নিয়মিত নমাজ পড়তে যেতেন মসজিদে। গত কালের পর থেকে তাঁর খোঁজ নেই। গাড়িটাও নেই। খোঁজ নেই ক্যান্টারবেরির মুসলিম সংগঠনের পরিচিত মুখ, ৫৯ বছরের আবদেলফাতা কাশেমের।
অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার আলি এলমাদানির মেয়ে মাহা অবশ্য জেনেই গিয়েছেন বাবার মৃত্যুর কথা। জানালেন, ১৯৯৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে চলে আসার পরে নিউজ়িল্যান্ডকেই ঘরবাড়ি করে-নেওয়া বাবা কোনও দিন ভাবেননি, এ-দেশেও এমন হতে পারে।
আর এক সন্তান, ৪৩ বছরের ওমর নবী তাঁর বাবার নশ্বর দেহ সমাহিত করতে চান পূর্বপুরুষের দেশ আফগানিস্তানে। হাজি দাউদ নবী গত কাল একাই গিয়েছিলেন মসজিদে। বিকারগ্রস্ত বন্দুকবাজ এক তরুণের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে ধরেছে দেখে বুক দিয়ে তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন ৭১ বছরের আফগান। বন্ধুর মুখে সেই কথা শুনে চরম শোকেও বাবার জন্য গর্ব হচ্ছে ওমরের। বলছেন, ‘‘বাবা তো এমনই। যেন অন্যের জন্যই বেঁচে রইল সারাটা জীবন।’’
শুধু বাঁচবেন বলেই মাসছয়েক আগে ভিটেমাটি ছেড়ে এই দেশে এসেছিলেন খালেদ মুস্তাফা। সঙ্গে স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে। নিজেদের দেশ সিরিয়ার বারুদগন্ধ মন থেকে ফিকে হচ্ছিল আস্তে আস্তে। বিশ্বাসও জন্মাচ্ছিল, খারাপ কিছু হবে না আর। গত কাল মসজিদে মুস্তাফা মারা গিয়েছেন গুলি খেয়ে, ১৬ বছরের ছেলে হামজ়ার খোঁজ নেই। ছোট ছেলে জ়াইদের ছ’ঘণ্টা ধরে অস্ত্রোপচার হয়েছে কাল।
অনিশ্চিতের পথে ভাসতে ভাসতে আসা। আজ সত্যিই ভেসে গিয়েছে শরণার্থী মুস্তাফার পরিবার। কে জানে, আরও কত পরিবার। নামের তালিকায় চোখ বোলাতে বোলাতে ক্লান্ত কত হাজার চোখ। ‘‘কোনও খবর আছে? বেঁচে আছে সে?’’
ছবি: রয়টার্স।