শেখ হাসিনা। —ফাইল ছবি।
৫০ বছর আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানকারীরা নৃশংস ভাবে খুন করেছিল তাঁর পিতা মুজিবুর রহমান-সহ গোটা পরিবারকে। জার্মানিতে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন শুধু শেখ হাসিনা এবং তাঁর বোন রেহানা। ঘটনাচক্রে, সেই হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দশক পূর্তির ঠিক আগেই ‘গণঅভ্যুত্থানে’ ক্ষমতা হারাতে হয়েছে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকে। প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়ার পরে গত ৫ অগস্ট থেকে ভারতে রয়েছেন তিনি।
এই আবহে বঙ্গবন্ধু মুজিবের হত্যাকাণ্ডের বর্ষপূর্তির আগে জাতির উদ্দেশে বার্তা দিলেন হাসিনা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই বার্তার অন্তিম অংশে রয়েছে গত ১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া পড়ুয়াদের আন্দোলনের প্রসঙ্গও। যে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছিল, ‘এক দফা দাবি’ (প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে হাসিনার অপসারণ)-তে। মঙ্গলবার ‘প্রিয় দেশবাসী, আসসালামুয়ালাইকুম’ সম্বোধনে প্রচারিত হয়েছে সেই বার্তা। বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া সেই বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘‘ভাই ও বোনেরা, ১৯৭৫ সালে ১৫ই অগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। একই সঙ্গে আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা, আমার তিন ভাই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, মুক্তিযোদ্ধা লেফটেনেন্ট শেখ জামাল, কামাল ও জামালের নবপরিণীতা বধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, আমার ছোট ভাই যার বয়স মাত্র ১০ বছর ছিল, শেখ রাসেলকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। আমার একমাত্র চাচা মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গু শেখ নাসের, রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার জামিলউদ্দিন, পুলিশ অফিসার সিদ্দিকুর রহমানকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। তাঁদের শ্রদ্ধা জানাই।’’
যুবলীগের কর্মসূচির প্রচার। ছবি: সমাজমাধ্যম থেকে।
ধানমন্ডিতে মুজিবের বাসভবনের পাশাপাশি ঘাতক সেনা অফিসারেরা সে দিন তাঁর পরিজনেদের বাড়িতেও হত্যালীলা চালিয়েছিলেন। সেই প্রসঙ্গ ছুঁয়ে হাসিনা লিখেছেন, ‘‘মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, কৃষি মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব সারনিয়াবাদ, তাঁর ১০ বছরের ছেলে আরিফ ১৩ বছরের মেয়ে বেবি, ৪ বছরের নাতি সুকান্ত, ভাইয়ের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক শাহিদ সারনিয়াবাদ, ভাগ্নে রেন্টু-সহ অন্যান্য অনেককে নির্মম ভাবে ভাবে হত্যা করে। ১৫ই আগস্ট যাঁরা শাহাদাত বরণ করেছেন তাঁদের সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং শহিদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।’’
এর পরেই হাসিনার বার্তায় এসেছে সাম্প্রতিক অস্থিরতা এবং ক্ষমতার পালাবদলের ঘটনা। তিনি লিখেছেন, ‘‘গত জুলাই মাস থেকে আন্দোলনের নামে যে নাশকতা, অগ্নি সন্ত্রাস ও সহিংসতার কারণে অনেকগুলি তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। ছাত্র, শিক্ষক, পুলিশ এমনকি অন্তঃসত্ত্বা নারী পুলিশ, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক সেবী, কর্মজীবী মানুষ, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা কর্মী, পথচারী এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত যাঁরা সন্ত্রাসী আগ্রাসনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের প্রতি শোক জ্ঞাপন করছি এবং তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।’’
হাসিনা লিখেছেন, ‘‘স্বজনহারা বেদনা নিয়ে আমার মতো যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা জানাই। আমি এই হত্যাকাণ্ড ও নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছি।’’ গত ৫ অগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত সেই ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি তছনছ করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল বিক্ষোভকারী জনতা। সেই প্রসঙ্গের উল্লেখ করে হাসিনা লিখেছেন, ‘‘১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে যে নারকীয় হত্যার ঘটনা ঘটেছিল সেই স্মৃতি বহনকারী বাড়িটি আমরা দুই বোন বাংলার মানুষকে উৎসর্গ করেছিলাম। গড়ে তোলা হয়েছিলো স্মৃতি জাদুঘর। দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এই বাড়িতে এসেছেন। স্বাধীনতার স্মৃতিবহনকারী এই জাদুঘরটি।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে স্মৃতিটুকু বুকে ধারণ করে আপনজন হারাবার সকল ব্যথা বেদনা বুকে চেপে রেখে বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার লক্ষ্য নিয়ে প্রিয় দেশবাসী আপনাদের সেবা করে যাচ্ছি। তার শুভ ফল ও আপনারা পেতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। আজ তা ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে।
আর যে স্মৃতিটুকু আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল তা পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে। চরম অবমাননা করা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি, যাঁর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা পেয়েছি আত্মপরিচয় পেয়েছি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। লাখো শহীদের রক্তের প্রতি অবমাননা করেছে। আমি দেশবাসীর কাছে এর বিচার চাই।’’
জাতির উদ্দেশে লেখা খোলা চিঠির শেষে মুজিব-কন্যার বার্তা— ‘‘প্রিয় দেশবাসী, আপনাদের কাছে আবেদন জানাই যথাযথ মর্যাদার সাথে ভাব গম্ভীর পরিবেশে জাতীয় শোক দিবস ১৫ই অগস্ট পালন করুন। বঙ্গবন্ধু ভবনে পুষ্প মাল্য অর্পণ ও দোয়া মোনাজাত করে সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বাংলাদেশের মানুষের মঙ্গল করুন। খোদা হাফেজ। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।’’ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, হাসিনার দল আওয়ামী লীগের যুব সংগঠনের তরফে আগামী ১৫ অগস্ট ‘ধানমন্ডী ৩২ এ চল’ অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছে।