প্রতীকী ছবি।
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ। হঠাৎ করে করোনা-সংক্রমণের খবর আসতে শুরু করল উত্তর ইটালির বিভিন্ন ছোট ছোট শহর থেকে। কিন্তু যে শহরে থাকি, সেই বোলোনিয়ায় দেখলাম স্থানীয়রা একটুও শঙ্কিত নন। আমাকে অনেকেই আশ্বস্ত করলেন, অহেতুক আতঙ্কিত হবেন না। বয়স্ক মানুষ ছাড়া কারও ভয় পাওয়ার কোনও দরকার নেই।
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে ছবিটা পাল্টে গেল। সংক্রমণ বাড়ছে হু-হু করে। দেখতে দেখতে সংক্রমিতের সংখ্যা দশ হাজার ছাড়াল। উত্তর ইটালির শহর কোদোনিয়া ও তার চারপাশে যে ‘রেড জ়োন’ তৈরি করে কোয়ারেন্টাইন এলাকা তৈরি হয়েছিল, তার আয়তনটা বাড়তে শুরু করল। একটু একটু করে সংক্রমণের সঙ্গে আমাদের দূরত্বটা যেন কমে গেল।
প্রথমে ভেবেছিলাম, দেশে ফিরে যাই। কিন্তু সামনে একাধিক প্রজেক্ট শেষ করার কথা। ফিরে যাব বললেই তো আর যাওয়া যায় না! তাই ভাবলাম, ফিরে যাব কি না, সেটা পরে দেখব, আপাতত ওষুধের দোকানে গিয়ে মাস্ক আর স্যানিটাইজ়ার কিনে রাখি। এই শহরটা ছোট। ঘণ্টা তিনেক তন্নতন্ন করে খুঁজেও ১৪-১৫টা ওষুধের দোকানে একটাও মাস্ক বা এক শিশি স্যানিটাইজার পেলাম না। অ্যামাজ়নে মাস্কের অর্ডার দিতে গিয়ে দেখি, সেখানেও অন্তত দু’সপ্তাহ লাগবে। বুঝতে পারলাম, আরও অনেক আগে থেকেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
প্রথমে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে, সেই জানুয়ারি থেকে চিনের সব উড়ান বন্ধ করে দিয়েছে ইটালি, তা হলে সংক্রমণ এত বেড়ে গেল কী করে! ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘খোলা সীমান্ত নীতি’র জন্যও যে সংক্রমণ ছড়িয়েছে সেটা বুঝতে কিছু দিন সময় লাগল। তা ছাড়া, সরকার থেকে অনেক দিন ধরেই ‘জমায়েত করবেন না’, ‘যতটা সম্ভব ঘরে থাকুন’ জাতীয় নানা সতর্কবার্তা জারি করা হচ্ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ সে সবে বিশেষ কান দিচ্ছিলেন না। বাঙালিদের মতো এখানকার মানুষজনও যথেষ্ট আড্ডাপ্রিয়। ‘সামান্য’ সর্দি-কাশির ভয়ে সেই সব থামিয়ে দিতে হবে, প্রথমে মানতেই চাননি স্থানীয়েরা। ইটালি মাত্র ৬ কোটি মানুষের দেশ। এখানে দু’জনের মধ্যে ১ মিটার দূরত্ব বজায় রাখা খুব কঠিন নয়। তবু সংক্রমণ এতটা ভয়াবহ আকার নিল। আজই কাগজে পড়লাম, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন ১৮৯ জন!
গত শনিবার রাতে উত্তর ইটালিকে ‘কোয়ারেন্টাইন’ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই বোঝা যাচ্ছিল, এর পরে সারা দেশকেই গৃহবন্দি করে ফেলা হবে। মঙ্গলবার থেকে তা-ই হল। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ ছাড়া সংক্রমণ আটকানোর আর কোনও উপায় নেই। এখন একমাত্র উপায় বাড়ি থেকে না-বেরোনো, মানুষে-মানুষে সংযোগ কমানো, যাতে ভাইরাস ছড়াতে না-পারে। তাই পুরো ইটালি এখন বাড়িতে বসে। হয়তো আরও আগে থেকে বাড়িবন্দি হলে ভাল হত। হয়তো সরকার যদি সিদ্ধান্তটা এক সপ্তাহ আগে নিত, মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেত না। হয়তো ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন বা আমেরিকার মতো দেশ যদি এখনই এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের অবস্থা আরও খারাপ হবে না। (চলবে)
লেখক বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো।