আলোড়ন ফেলা সেই চুমু। —ফাইল চিত্র
সাদা পোশাক পরা ছিপছিপে এক তরুণী। হাঁটু পর্যন্ত ঝুলের সাদা গাউন। পায়ে অল্প হিলের সাদা নিউকাট। ছিপছিপে সেই সুন্দরীর কোমরে হাত দিয়ে জাপটে ধরে আছেন এক নাবিক। তরুণীর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে। আশপাশে বেশ কিছু কৌতূহলী চোখও আকস্মিক এই চুম্বনে হতবাক!
নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে আবেগঘন এই চুম্বনের দৃশ্যটি ধরা পড়েছিল বিখ্যাত এক ফটোগ্রাফারের ক্যামেরাতে! তবে ফটোগ্রাফার বা ছবিতে থাকা তরুণ-তরুণী— কেউই জানতেন না, এই ছবিটাই এক সময় সাড়া ফেলে দেবে। বয়ে বেড়াবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের আনন্দের স্মৃতি!
কালজয়ী এই ছবির হাত ধরেই খ্যাতির শিখরে উঠে এসেছেন সেই ফটোগ্রাফার। বিখ্যাত হয়ে গিয়েছেন ছবির সেই তরুণ-তরুণীও।
তবে তার আগে ছবিটিতে থাকা দু’জনের পরিচয় নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। ছবিতে নিজেরা আছেন বলে দাবি করেছিলেন অনেকেই। এত দাবিদারের মধ্যে বহু পরীক্ষার পরে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ছবির আসল পাত্র-পাত্রীকে। জানা যায়, ওই তরুণ নাবিকের নাম জর্জ মেন্ডোসা। আর যাঁকে আলিঙ্গন করে তিনি চুম্বন করছেন, সেই তরুণী ছিলেন পেশায় নার্স। নাম গ্রেটা জিমার ফ্রিডম্যান।
কালের নিয়মে ছবির সেই তরুণী বৃদ্ধ হয়েছেন। কাটিয়ে দিয়েছেন আরও একাত্তরটা বছর। দীর্ঘ অসুস্থতার পরে অবশেষে ৯২ বছরে থেমে গেল সাড়া ফেলে দেওয়া সেই সুন্দরীর জীবন। গ্রেটার ছেলে জোশুয়া ফ্রিডম্যান জানাচ্ছেন, দীর্ঘদিন ধরেই নিউমোনিয়া-সহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন তাঁর মা। গত বৃহস্পতিবার ভার্জিনিয়ায় রিচমন্ডের এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন গ্রেটা।
১৪ অগস্ট ১৯৪৫। আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে জাপান। আর এই খবর পাওয়ার পরেই তখন আনন্দে ফুটছে মার্কিন মুলুক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের আনন্দে ও উল্লাসে রাস্তায় নেমে পড়েছেন বহু মানুষ। নিউ ইয়র্কের রাস্তায় তখন থিকথিক করছে ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যেই ছিলেন গ্রেটাও। আচমকাই পিছন থেকে এসে তাঁর কোমর জাপটে ধরেন মেন্ডোসা। টাল সামলাতে না পেরে গ্রেটাও ধরা দেন মেন্ডোসার আলিঙ্গনে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্রেটার ঠোঁটে নেমে এসেছিল মেন্ডোসার ঠোঁট। আর সেই দৃশ্য লেন্সবন্দি করে ফেলেন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার আলফ্রেড আইজেনস্টাড।
এর কিছু দিন পরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সাদা-কালো ছবিটি ছাপা হয় এক বিখ্যাত মার্কিন পত্রিকায়। তার পর ছবির সেই তরুণ-তরুণীর পরিচয় নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। অন্তত ১১ জন নিজেদের ওই নাবিক বলে দাবি করেন। আর তিন জন মহিলা নিজেদের ওই সুন্দরী বলে দাবি করেছিলেন। এঁদের মধ্যে গ্রেটাও ছিলেন। ছবির ওই তরুণীই যে গ্রেটা, কী ভাবে সামনে এল তা?
১৯৬০ সালে একটি পত্রিকায় আইজেনস্টাডের সেই ছবি দেখে নিজেকে চিনতে পারেন গ্রেটা। তখনই তিনি ওই পত্রিকার দফতরে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, ছবিটির ওই তরুণী আর কেউ নন। তিনিই। কিন্তু সেই সময় তাঁর সেই দাবি খারিজ করে দেওয়া হয়। ওই পত্রিকার তরফে তাঁকে জানানো হয়, অন্য এক জন মহিলা ওই ছবিতে ছিলেন।
ওই পত্রিকার দাবি মানতে পারেননি গ্রেটা। অবশেষে ১৯৮০ সালে দু’জনের পরিচয় নিশ্চিত ভাবে জানা যায়। দেখাও হয় দু’জনের। ছবিতে যে গ্রেটা ও মেন্ডোসাই রয়েছেন, তা পরিষ্কার হয়ে যায়। পরে ২০০৫ সালে একটি সাক্ষাৎকারে গ্রেটা বলেন, ‘‘আমি জানতাম ওটা আমি। কারণ ঘটনাটা আমার সঙ্গেই ঘটেছিল। একদম আমার চেহারা। আর আমার পোশাক। বিশেষ করে আমার সেই চুল বাঁধা। ওটা দেখেই চিনতে পারি।’’
বিশ্বযুদ্ধ শেষের ৩৫ বছরের মাথায় একটি অনুষ্ঠানে ডাকা হয়েছিল গ্রেটা ও মেন্ডোসাকে। সেখানেই দ্বিতীয় বার দেখা হয় দু’জনের। আয়োজকরা চেয়েছিলেন, আরও এক বার চুম্বনে আবদ্ধ হোন দু’জনে। বন্ধুত্বের আলিঙ্গনে ধরা দিলেও দ্বিতীয় বার আর চুমু খেতে রাজি হননি তাঁরা। তবে একটা বন্ধুত্বের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে দু’জনের মধ্যে। এর পর থেকে বড়দিনে শুভেচ্ছাবার্তাও পাঠাতেন পরস্পরকে।
গ্রেটা জানিয়েছিলেন, ওই চুম্বনটা তাঁর কাছে রোমান্টিক কিছু ছিল না। ছিল যুদ্ধ শেষের আনন্দ উদ্যাপনের এক মুহূর্ত। বিশ্বের কাছে অবশ্য এ ছবি তার চেয়েও কিছু বেশি। যুদ্ধের বিভীষিকা ছাপিয়ে জীবনের জয়গান।
সাদা-কালো ছবিটি যে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল, তার আরও একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন আলোকচিত্রী নিজেই। তাঁর বক্তব্য, ছবিটিতে ফুটে উঠেছে সাদা-কালোর এক অপূর্ব মিশেল। ১৯৮৫ সালে এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ফটোগ্রাফার আলফ্রড জানিয়েছিলেন, ওই নার্স এবং নাবিক যদি একই রঙের পোশাক পরে থাকতেন, তবে সেই ছবি তিনি তুলতেনই না।’’
তবে বিতর্ক অবশ্য পিছু ছাড়ছে না বিশ্বযুদ্ধ শেষের সেই সুখ-স্মৃতির। কারণ, নতুন প্রজন্মের কাছে এই ছবিটি এখন যৌন নিগ্রহের একটা মুহূর্ত ছাড়া আর কিছুই নয়!