ম্যাসাচুসেটস ছেড়ে চলে গেল ন্যাশনাল গার্ড। গত তিন মাস ধরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব পালন করে গেলেন দেশে-বিদেশে নানা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কাজ করে আসা এই সেনারা। কী সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০২০-তে।
অতিমারির প্রথম ঝড়ে বিধ্বস্ত আমেরিকার স্কুল-কলেজগুলি প্রথম ধাক্কা সামলে উঠে কয়েক মাসের মধ্যেই দ্রুত চলে গিয়েছিল অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতিতে। ২০২০-র সেপ্টেম্বরে, অর্থাৎ নতুন শিক্ষাবছরের শুরুতে, রোগের প্রকোপ ও সংক্রমণ যথেষ্ট বেশি ছিল। তাই সারা দেশের বিভিন্ন প্রদেশের স্কুলগুলির মধ্যে বেশির ভাগই পড়াশোনা শুরু করেছিল সম্পূর্ণ অনলাইন পদ্ধতি। কয়েকটি স্কুল অবশ্য অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করে ‘হাইব্রিড মডেল’-এ স্কুল খোলে। প্রতিষেধক তখনও অনেক দূরে! আমার স্কুলে, ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে ছাত্রছাত্রীরা অর্ধেক সময়ে স্কুলে বাকি অর্ধেক সময়ে অনলাইনে পড়াশোনা করত। স্কুলের দিনগুলোর ছবি সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিল তখন থেকেই। মাস্ক বা ডাবল মাস্ক, ঘন ঘন হাত ধোয়া ও স্যানিটাইজ় করা, প্রত্যেক পিরিয়ডের পরে নিজেদের ডেস্ক স্যানিটাইজ় করা আর প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও জানলা খানিকটা খোলা রাখা, ড্যাশ বোর্ডে নিয়মিত কোয়রান্টিনের আপডেট, ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যখন-তখন কোয়রান্টিনে যাওয়ার আশঙ্কা— এই প্রবল অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কার মধ্যেও কিন্তু স্কুল চলেছে। ভ্যাকসিন চালু হওয়ার পরে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি একটু একটু করে বদলাতে শুরু করে। আর তখনই আমাদের প্রদেশ ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর চার্লি বেকার এই প্রদেশের ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে ফেরত আসার উপরে যথেষ্ট জোর দিতে শুরু করেন।
এই শিক্ষাবর্ষে যখন ম্যাসাচুসেটসে টিকাকরণের হার প্রায় সত্তর শতাংশ হল, আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, এ বার অফলাইন পদ্ধতিতে স্কুল খুলবেই। প্রচুর আলোচনা ও বিরোধিতার অনেক ধাপ পেরিয়ে ২০২১-এর অগস্ট-সেপ্টেম্বরে কিন্ডারগার্টেন থেকে দ্বাদশ শ্রেণির স্কুল শুরু হল। আর স্কুল খোলা মাত্রই দেখা দিল একটি অপ্রত্যাশিত সমস্যা। পুরো এক বছর অনেকাংশে অনলাইন স্কুল হওয়াতে, স্কুলের বাসচালকেরা অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন। অনেকেই আবার নির্ধারিত বয়সের আগেই অবসর নিয়ে নেন বা পেশা বদলাতে বাধ্য হন। অনেকে আবার অ্যামাজ়ন বা ইউপিএসের মতো সংস্থায় চালক হিসাবে যোগদান করেন। স্কুল বাস ড্রাইভারের সংখ্যা কমে যাওয়ায়, বস্টনের মতো বড় শহরে বা চেলসি, লোয়েলের মতো শহরেও শুরু হয় ভীষণ পরিবহণ সমস্যা। স্কুল খোলার প্রথম দিনেই বস্টনে ১২০০ স্কুলবাস অনেক দেরি করে স্কুলে পৌঁছয়। সে দিন ৪০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছতেই পারেনি। এই সমস্যা শুধু আমাদের প্রদেশে নয়, আমেরিকার বহু জায়গাতেই শুরু হয়। যেমন, নিউ ইয়র্ক প্রদেশে ১৫ থেকে ২০% বাস ড্রাইভার ঘাটতি দিয়ে স্কুলবর্ষ শুরু করেছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য গভর্নর চার্লি বেকার একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নেন। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে থেকে ‘ন্যাশনাল গার্ডের’ সাহায্য চান তিনি।
ন্যাশনাল গার্ড বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং গত এক বছরে কোভিড মোকাবিলায়, কোভিড পরীক্ষা, টিকাকরণ ক্যাম্প এমনকি প্রয়োজনে খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজে ছিল অসম্ভব সক্রিয়। কিন্তু বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছনোর জন্য সেনাদের ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত এই প্রথম। ২০০ জনের বেশি ন্যাশনাল গার্ডের সেনা এই কাজ শুরু করেন। এমনই এক সেনা, সার্জেন্ট ফিলিপ হিকম্যান একটি সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন,‘‘ইউএস ৬০ ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারের পাইলট হিসাবে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতাম, এখন চেলসি শহরে একটি মিডল স্কুলের সামনে বসে ছাত্রছাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছি। অনেক আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করেছি। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে খুবই মূল্যবান।’’ এই পোড়-খাওয়া সেনাকে সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেন, নানা ধরনের জরুরি অবস্থায় কাজ করার পরেও কেন এ রকম বলছেন তিনি? ফিলিপ উত্তর দেন, ‘‘কারণ প্রত্যেক দিনছোট ছোট ভ্যানে করে অত্যন্ত মূল্যবান জিনিস স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছি, আবার ঠিক সময়ে বাড়ি ফেরত নিয়ে আসছি আমরা। আসলে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়াটা যে একটা এমার্জেন্সি, সেটাই এই কয়েক মাসে বুঝতে পারলাম!’’
এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়ায় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ম্যাসাচুসেটস ছাড়ল ন্যাশনাল গার্ড। রেখে গেল জরুরি পরিষেবার এক অনন্য উদাহরণ।