হাতে হাত: শ্রীলঙ্কার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। শুক্রবার হায়দরাবাদ হাউসে। ছবি: প্রেম সিংহ
চিত্রনাট্য মেনেই আজ শ্রীলঙ্কার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপনের প্রথম পদক্ষেপটি করল নয়াদিল্লি। কূটনৈতিক শিবিরে প্রশ্ন উঠছে, কত দিন ধরে রাখা যাবে এই মসৃণতা? প্রতিবেশী কূটনীতিতে কোণঠাসা ভারতের সামনে গোতাবায়া রাজাপক্ষ যে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারেন, সে বিষয়ে সাউথ ব্লকের মনে বিশেষ সন্দেহ নেই!
আজ রাজধানীর হায়দরাবাদ হাউসে শ্রীলঙ্কার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ককে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কথা জোর গলায় বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সাড়া দিয়েছেন গোতাবায়াও। ঠিক ছ’বছর আগে এই রাজাপক্ষকেই ডেকে পাঠিয়েছিল সাউথ ব্লক। কড়াভাষায় সে দিন জানতে চাওয়া হয়েছিল, সে দেশের উপকূলে চিনা ডুবোজাহাজের কার্যকলাপ সম্পর্কে। তখন শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষাসচিব ছিলেন গোতাবায়া।
অতীতের সেই দাগ মুছে ফেলে নরেন্দ্র মোদী এবং গোতাবায়া রাজাপক্ষের সৌভ্রাতৃত্বের ছবিটা যাতে সুনিপুণ করা যায়, তার জন্য যথেষ্ট সক্রিয় ছিল মোদী সরকার। চিনা ঘনিষ্ঠ রাজাপক্ষ পরিবারকে নিজেদের শিবিরে আনতেই এই বাড়তি সক্রিয়তা বলে মনে করছেন কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে তড়িঘড়ি কলম্বো পাঠানো হয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে। এর আগে যা কখনও করা হয়নি। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, এর পিছনে ছিল দ্বিমুখী কৌশল। প্রথমত, এই বার্তা দেওয়া যে অতীতের তিক্ততা ভুলে গিয়ে সাদা কাগজে নতুন করে দ্বিপাক্ষিক ভাষ্য তৈরি করতে চায় ভারত। দ্বিতীয়ত, গোড়াতেই বুঝিয়ে দেওয়া যে তামিল প্রশ্নে সহযোগিতা আশা করা হচ্ছে। কলম্বো থেকে ফেরার পরেই বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘তামিল সম্প্রদায়ের শান্তি এবং ন্যায়ের জন্য এবং তাদের যাবতীয় আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য শ্রীলঙ্কা সরকার পদক্ষেপ করতে শুরু করুক।’ বিদেশ মন্ত্রকের দাবি, বহু বছর পর এ ভাবে চড়া স্বরে শ্রীলঙ্কার তামিল সমস্যা নিয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়া হল। তবে এই দাবি করলেও পাশাপাশি এ কথাও ঘরোয়া ভাবে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে যে, রাজাপক্ষ সরকারের কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত এমন কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি যাতে বোঝা যায় যে তামিল এবং মুসলমান অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের নিয়ে বিশেষ কোনও মাথাব্যথা অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে সে দেশের সরকারের।
আরও পড়ুন: ‘গড ফাদার’ রাজনৈতিক নেতার মদতেই পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে মাদকের জাল বিস্তার জয়দেবের
কূটনৈতিক শিবির বলছে, প্রতিবেশী হিসেবে সমস্ত রকম সহযোগিতা রাজাপক্ষ পরিবারের সঙ্গে করতে যে তারা প্রস্তুত, সেই বার্তা গত কয়েক দিনে দিতে পেরেছে ভারত। কিন্তু বিনিময়ে শ্রীলঙ্কাকেও তামিল প্রশ্নে ভারতের দাবি মেনে নিতে হবে। অগ্নিগর্ভ প্রতিবেশী বলয়ের মধ্যে বসে থাকা ভারতের পক্ষে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে শত্রুতা তৈরি করা যে হারাকিরির সমান হবে সেটা বুঝতে পারছেন নরেন্দ্র মোদী। ভারত জানে যে, প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে প্রথম বিদেশসফর হিসেবে ভারতকে গোতাবায়া বেছে নিলেও তাতে দিল্লির খুব আনন্দিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। খুব শীঘ্রই বেজিং সফরে যাবেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট। সেখানে তৈরি হবে বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত ভাবে পুরনো ও গভীর সম্পর্ককে নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি। দ্বীপরাষ্ট্রকে কাজে লাগিয়ে ভারতের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে এর আগে যে ভাবে সক্রিয় থেকেছে চিন, রাজাপক্ষের প্রত্যাবর্তনে তারই ধারাবাহিকতা ফিরে আসতে পারে বলে আশঙ্কা সাউথ ব্লকের।
সাউথ ব্লকের সম্পর্কে যাতে অতীতের ছায়াপাত না হয় সে জন্য অতিরিক্ত উদ্যোগী মোদী সরকারের পক্ষ থেকে নতুন করে ৪৫ কোটি ডলারের ঋণ (সহজ সুদে) ঘোষণা করা হল। এর মধ্যে চল্লিশ কোটি ডলার সে দেশের পরিকাঠামো উন্নয়নে এবং ৫ কোটি ডলার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে বলে জানানো হয়েছে। মোদীর কথায়, ‘‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা নিয়ে কথা হয়েছে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। এ ব্যাপারে দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর পন্থা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার পুলিশ অফিসারেরা নিয়মিত সন্ত্রাস মোকাবিলার বিষয়টি নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বিভিন্ন ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে।’’