সেই পাক সাংবাদিক জিনাত শাহজাদি। ছবি: সংগৃহীত।
ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা। ভিড়ে ঠাসা ঘিঞ্জি পথঘাটে লোকজনের আনাগোনা অহরহ। এ হেন লাহৌরের রাস্তা থেকে বছর দুয়েকে আগে দিনের আলোয় ‘নিখোঁজ’ হয়ে গিয়েছিলেন বছর ছাব্বিশের পাক সাংবাদিক জিনাত শাহজাদি। গত ১৯ অক্টোবর আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে তাঁকে উদ্ধার করেছে পাক-প্রশাসন। জানানো হয়েছে, কিছু রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠন অপহরণ করেছিল জিনাতকে। তবে তারা কারা বা সেই অপরাধে আদৌ কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে কি না, তা জানানো হয়নি প্রশাসনের তরফে।
১৯ অগস্ট, ২০১৫ সাল। হঠাৎই হারিয়ে যান জিনাত। লাহৌরের ভিড়ে ঠাসা রাস্তায় প্রত্যক্ষদর্শীর অভাব হয়নি। তাঁদের মুখেই শোনা গিয়েছিল, অটো রিকশায় বাড়ি থেকে অফিস যাওয়ার পথে কিছু অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতী অপহরণ করে তাঁকে। জিনাত সেই সময়ে ভারতীয় নাগরিক হামিদ আনসারির পাকিস্তানে এসে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিয়ে টানা একের পর এক খবর করছিলেন। তাঁর পরিবারের লোকজন দাবি করেন, ওই খবরের জেরেই তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে।
পাকিস্তানে অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২০১২ সালে মুম্বইয়ের বাসিন্দা আনসারিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। জেরায় তিনি জানিয়েছিলেন, ইন্টারনেটে বন্ধুত্ব হওয়া এক তরুণীর সঙ্গে দেখা করতে পাকিস্তানে এসেছেন তিনি। দু’বছর আগে আনসারিকে নিয়ে খবর করতে গিয়ে তাঁর মায়ের সঙ্গে আলাপ হয় জিনাতের। পাক সুপ্রিম কোর্টের মানবাধিকার সেলে আনসারির মা ফৌজিয়া আনসারির হয়ে আবেদন জানান তিনি। ২০১৩ সালে ফৌজিয়া বিশেষ ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ দেন জিনাতকে। আনসারির মায়ের হয়ে পেশোয়ার হাইকোর্টে মামলা করেন জিনাত। ‘কমিশন অব এনকোয়েরি অন এনফোর্সড ডিসাপিয়ারেনস’ (সিআইইডি)-র কাছে আবেদন জানান তিনি। তাদেরই নির্দেশে ২০১৪ সালে এফআইআর গ্রহণ করা হয়। সেই সময়েই জিনাত পেশোয়ার কোর্টে হিবিয়াস করপাস আবেদন জানান। এতে বন্দিকে আদালতের সামনে হাজির করানো হয়। বন্দির উপস্থিতিতেই বিচার করে দেখা হয়, তার কারাবাস আদৌ বৈধ কি না। জিনাতের দাদা সলমন লতিফ বলেন, ‘‘মামলা তুলে নেওয়ার জন্য বোনকে নানা ভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। আমরাও বলেছিলাম ওঁকে, কেন জীবনের ঝুঁকি নিবি? কিন্তু ও বলে, একটু সাহায্যের আশায় ওঁর কাছে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন আনসারির বৃদ্ধা মা। মানবিকতার খাতিরেই ও আনসারিকে সাহায্য করতে চায়।’’
জিনাতের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে আনসারির সম্পর্ক নিয়ে প্রশাসনের তরফে কোনও দিনই জবাব মেলেনি। ধীরে ধীরে মিডিয়া থেকে হারিয়ে গিয়েছিল ‘জিনাত অপহরণ-কাণ্ড’। বোনকে হারিয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন জিনাতের ভাই সাদ্দাম হুসেন। গত বছর মার্চ মাসে তিনি আত্মঘাতী হন।
এ দিকে, পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ ও ‘গুপ্তচর’ বৃত্তির অপরাধে সেনা আদালত আনসারিকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়। আদালতের রায়ে আনসারির মুক্তির দাবিতে সরব হয় মানবাধিকার সংগঠনগুলি। তাদের বক্তব্য ছিল, সাজা ঘোষণা হতে-হতে তিন বছর জেলে কাটিয়েই ফেলেছেন আনসারি। অতএব তাঁকে মুক্তি দেওয়া হোক। যদিও এ দাবি ধোপে টেকেনি। পাকিস্তানের জেলে এখনও বন্দি রয়েছেন আনসারি।
পাক মানবাধিকার কর্মী বীণা সরওয়ার জানান, লাহৌরে তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে জিনাতকে। সিআইইডি-র প্রেসিডেন্ট, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জাভেদ ইকবাল আজ বলেন, ‘‘জিনাতের সন্ধান পেতে ব্যাপক ভাবে সাহায্য করেছে বালুচিস্তান ও খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের আদিবাসীরা।’’ বোনকে ফিরে পেয়ে খুশি জিনাতের পরিবার। কিন্তু আক্ষেপ যাচ্ছে না। লতিফ বলেন, ‘‘আনসারিকে সাহায্য করতে অনেক দাম দিতে হল আমাদের। বোনকে খুঁজে পাচ্ছি না, ও দিকে ভাই আত্মহত্যা করল।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এক জন ভারতীয়কে সাহায্য করে জিনাত কি খুব বড় অপরাধ করেছিল!’’