দু’দশক পেরিয়ে ফের তালিবানি শাসনে আফগানিস্তান। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়ার জন্য বিমানে ওঠার মরিয়া চেষ্টা। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া
রানওয়েতে দাঁড়িয়ে আমেরিকান সেনাবাহিনীর দৈত্যাকার বিমান। দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রানওয়েতে ছোটা শুরু হবে এখনই। তার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন কয়েকশো মানুষ। প্লেনের চাকার সঙ্গে নিজেকে বেঁধে নিলেন কেউ কেউ। বিমানের দৌড় শুরু হতেই রানওয়ে ধরে ছুটতে শুরু করলেন অনেকে। দিনের শেষে শেষ বাস ধরার জন্য যে ভাবে মরিয়া দৌড়ন অফিসফেরতা মানুষ। বিমান আকাশে উঠতেই চাকা থেকে ঝুলছিলেন যাঁরা, টুপটাপ করে খসে পড়লেন। কয়েকশো ফুট উপর থেকে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল দেহ। কত জন মারা গেলেন এ ভাবে? এক...দুই...তিন...! আতঙ্কে তত ক্ষণে চোখ বন্ধ করে ফেলেছি আমি।
আজ সকালে কাবুল বিমানবন্দরে এই দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করতাম না বাড়ি ফেরার আকুতি কতটা তীব্র হতে পারে মানুষের। না করেই বা উপায় কী! ফেসবুক, টুইটার— বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে বিমানবন্দরের এই সব মর্মান্তিক ভিডিয়ো। আমেরিকান সেনা বিমান ছাড়াও আরও যে কয়েকটি হাতে গোনা বিমান আজ কাবুল বিমানবন্দর ছেড়েছে, সেই সব বিমানে ওঠার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছেন মানুষ। বিমানে ওঠার এরোব্রিজ ধরে ঝুলে পড়েছেন অনেকে। প্রাণপণ চেষ্টা, যদি কোনও ভাবে দরজা খুলে ভিতরে ঢোকা যায়।
এমন আতঙ্কের দৃশ্য আমার জীবনে কখনও দেখিনি! মনে হয় সারা জীবন আমাকে তাড়া করে বেড়াবে দৃশ্যগুলি!
কুড়ি বছর পরে আফগানিস্তান আবার তালিবানের দখলে। কালই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছেড়েছেন আশরফ গনি। আজ সকাল থেকেই প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে দাপিয়ে বেড়িয়েছে তালিবান নেতা-যোদ্ধারা। তালিবান শীর্ষ নেতা মোল্লা আব্দুল গনি বরাদর-ই আগামী প্রেসিডেন্ট বলে খবর।
কোলে শিশু। তালিবানের হাত থেকে বাঁচতে পাক-আফগান সীমান্তে সন্ত্রস্ত আফগান নাগরিক। ছবি রয়টার্স।
আজ সারা দিন ধরে বারবার বিবৃতি দিয়ে তালিবান দাবি করেছে, ভয়ের কিছু নেই। ক্ষমতার হাতবদল শান্তিপূর্ণই হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে তালিবান জমানার স্মৃতি তো দু’দশক পরেও টাটকা। তার উপরে আজ সকাল থেকে দেখছি, কাবুলের রাস্তায় রাস্তায় রকেট লঞ্চার নিয়ে ঘুরছে তালিবান যোদ্ধারা। ফলে এ দেশ ছেড়ে যে লোকে পড়িমরি পালানোর চেষ্টা করবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী!
আমার বাড়ি থেকে কাবুল বিমানবন্দর মেরেকেটে মিনিট পনেরো। কিন্তু পরিস্থিতির আঁচ করে সকাল দশটার উড়ান ধরতে ভোর সাড়ে পাঁচটাতেই ‘দুগ্গা’ বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। বিমানবন্দরে পৌঁছতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু তার পরে যা হল, যা দেখলাম, তা অভাবনীয়।
দিল্লির উড়ানের বুকিং আমার হাতে। কিন্তু বিমানবন্দরের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছি, কোনও উড়ান নেই। ভিতরে ঢোকা যাবে না। আমার চারপাশে তখন থিকথিকে ভিড়। কম করে আট-ন’হাজার লোক হবে। ভিতরে ঢুকে দেখি, কাউন্টারের কোনও নামগন্ধ নেই। দূতাবাস কর্মীদের জন্য আমেরিকার বিশেষ বিমানের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শয়ে শয়ে মানুষ। যদি কোনও ভাবে উঠে পড়া যায়। তখনও ঠিক জানি না যে, ভারতের উড়ান সত্যিই বাতিল হয়ে গিয়েছে। সকাল দশটায় আমার বিমান ছাড়ার কথা। অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করার পরে বুঝতে পারলাম, আজ দেশে ফেরা আমার ভাগ্যে নেই। হঠাৎ দেখি, জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে শূন্যে গুলি চালাচ্ছে আমেরিকান সেনা। আর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাচ্ছে মানুষ। পরে শুনলাম, পদপিষ্ট হয়েই তিন-চার জন মারা গিয়েছেন। এখনও পর্যন্ত বিমানবন্দরে সাত জনের মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার গোটা দিনটাই আমার ফোন ঘেঁটে দেশে ফেরার মরিয়া চেষ্টার মধ্যেই কাটল। তার পরে বাড়িতে মা-বাবাকে বোঝানো! খবর পেয়েছি, এখনও কোনও ‘কমার্শিয়াল ফ্লাইট’ কাবুল থেকে ছাড়বে না! তা হলে তো আশা করব, দেশের বিদেশ মন্ত্রকই আমায় ফেরাবে। বিদেশ মন্ত্রকের একটা টুইট দেখলাম, ওঁরা না কি কাবুলে আটকে পড়া সব ভারতীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন। কিন্তু কই, আমাদের সঙ্গে তো কেউ যোগাযোগ করেননি। আমি কিন্তু বিদেশ মন্ত্রকের এক জন কর্তার ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করেছিলাম। তিনি ফোন ধরলেন না। হোয়াটসঅ্যাপে ‘মেসেজ’ করেছি। উনি সেটা দেখেওছেন! কিন্তু কোনও সাড়া মেলেনি।
কাবুলে এখন আমার চেনা যে ক’জন ভারতীয় আছেন প্রত্যেকেই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। বিমানবন্দরে গিয়ে ফিরে আসার বিভীষিকার ঘোর কারও এখনও কাটেনি। আচ্ছা, আমরাও তো দেশে কর দিই। এই সঙ্কটে দেশের বিদেশ মন্ত্রকের আমলারা কেউ একটা খোঁজও করবেন না? আমি জানি না, দেশে কোন দল, কোন নেতার কাছে আমায় বাড়ি ফেরানোর আর্জি জানালে ফল মিলবে।
ইতিমধ্যে কাবুলে পুলিশ বা সেনার সব চেকপোস্টেই তালিবান বহাল। তবে এখনও অশান্তির খবর নেই। শহরে ফিরে এক সহকর্মীর বাড়িতে আছি! মাঝেমধ্যে দূর থেকে গুলির শব্দ পাচ্ছি। তবে তা তালিবানের উচ্ছ্বাসের প্রকাশ বলেই মনে হয়! এ দিকে, বাজারে জিনিসের দাম বাড়ছে। ব্যাঙ্ক বন্ধ। এখানে মোবাইল দোকানে গিয়ে আগাম রিচার্জ করতে হয়। শুনছি, সে-সব দোকানও বন্ধ। বাড়ির লোককে শান্ত করতেও একটু মুশকিল হচ্ছে। তবে আমি হাসতে হাসতেই বুঝিয়েছি, এখন এক জন সহকর্মীর বাড়িতে রয়েছি। বাড়ির খাবার খেতে পাচ্ছি। অনেক আরামে আছি। মা-বাবাকেও বলছি, তালিবান তো বিবৃতি দিয়ে বলছে, খামোখা রক্তপাত হিংসা ঘটবে না! ফলে কোনও সমস্যা নেই!
ভিতরে যতই উৎকণ্ঠা হোক, বয়স্ক মানুষজনদের সামনে তো সব কিছু প্রকাশ করা যায় না!
(লেখক কাবুলে কর্মরত)