সেনা-আধাসেনা সংঘর্ষে ভেঙেছে বাড়ি। সুদানে। রয়টার্স
গুলির আওয়াজে কান পাতা দায়। মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে বিকট বিস্ফোরণের শব্দও। বাড়ির বাইরে বেরোনোর কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু এ ভাবে কত দিন চলবে! খাবারের ভাঁড়ার বাড়ন্ত। পানীয় জল যা আছে, তাতেও বেশি দিন চলবে না।
নদিয়ার শান্তিপুরে সাহেবডাঙার ছেলে আমি। গত ১৫-১৬ বছর ধরে সুদানেই আছি। থাকি সুক আল আরবি এলাকায়। সোনার গয়না তৈরির ব্যবসা আমার। ৬ মাস অন্তর দেশে যাই। তবে এ বার কবে ফিরতে পারব, জানি না। পবিত্র রমজান মাস চলছে। এর মধ্যে খাবার ও জলের এই টানাটানিতে বেজায় সমস্যায় পড়েছি আমরা। আনাজ-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার কোনও উপায় নেই। কয়েক দিন আগে কেনা চাল-ডাল-তেল দিয়েই কোনও রকমে দিন কাটছে। খাবার বাড়ন্ত। আর সব থেকে বেশি চিন্তা জল নিয়ে। ঘরে আর সামান্য পানীয় জল রয়েছে। সে-টুকু শেষ হয়ে গেলে কী হবে, ভাবতেই ভয় লাগছে।
শুনেছি, সুদানে আটকে পড়া ভারতীয়দের জন্য একটি কন্ট্রোল রুম খুলেছে ভারতীয় দূতাবাস। ভারতীয়দের বলা হয়েছে, বিচলিত না হতে। জল, ওষুধ, অর্থ ও অন্য অত্যাবশ্যক দ্রব্য পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত রেখে বাড়ি থেকে একেবারেই না বেরোতে। কিন্তু শুধু নির্দেশিকা জারি করে কী হবে! বাস্তবে দূতাবাসের কাছ থেকে কোনও সাহায্যই পাচ্ছি না।
আজ দিনভর গুলির শব্দ শুনেছি। (আনন্দবাজারের প্রতিনিধি যখন খালিদের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন সুদানে স্থানীয় সময় দুপুর ৩টে, সমানে কানে আসছে গুলির শব্দ)। আমাদের বাড়ির পাশেই চলছে গোলাগুলি। তার জেরে রাস্তায় বেরোনো তো বটেই, বাড়ির খোলা জায়গায় যাওয়ারও সাহস পাচ্ছি না কেউ। বিমানবন্দর থেকে এই অঞ্চলটির দূরত্ব মাত্র ১০ মিনিট। কাল থেকেই বিমানবন্দরে লাগাতার বিস্ফোরণ হচ্ছে বলে খবর পেয়েছি। চার দিন ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। মৃতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ২০০ ছাড়িয়েছে। সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো। হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়ছে ভিড়। পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধও নেই। আহতের সংখ্যা দু’হাজার ছাড়িয়েছে বলে শুনলাম। তবে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম থেকে খবর পেলাম, আজ সন্ধে ছ’টা থেকে ২৪ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির চুক্তি মেনে নিয়েছে দু’পক্ষ। আশা করি এর পরে পরিস্থিতির একটু উন্নতি হবে।
এখন অশান্তি চূড়ান্ত আকার ধারণ করলেও গত পাঁচ বছর ধরেই সুদানে অশান্তির পরিবেশ রয়েছে। সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র চাইছেন। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন সামরিক শাসক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্যের আশ্বাস দিলেও তা মেলেনি। এই নিয়ে শাসকের সঙ্গে সাধারণ মানুষের গন্ডগোল বেঁধেছে। কিন্তু এ বারের অশান্তি বহরে ব্যাপক। সাধারণ মানুষও এ বারের সংঘর্ষে বেশ বিভ্রান্ত! কোন পক্ষ ভাল, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। এ বারের অশান্তিতে সাধারণ মানুষের কোনও ভূমিকা নেই। করোনার আগের সেই গন্ডগোলের সময়ে কাঁদানে গ্যাস চলত। সেই সময়ে বিকেলে দোকান খুলত। ফলে দিনে অন্তত এক বার খাবার মিলত। কিন্তু এ বারে তা একেবারেই বন্ধ। আগে আমার পরিবারও খার্তুমে থাকত। কিন্তু বছরখানেক আগে ঝামেলার আঁচ পেয়ে সবাইকে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এখন চার জন মিলে একটা বাড়িতে থাকি। পাশাপাশি রয়েছে বন্ধুরাও।
আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ থাকলেও রাস্তার উল্টো পারে তা-ও নেই। শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা বিদ্যুৎহীন। অশান্তি থামলেও ব্যবসা ছেড়ে এখনই দেশে ফেরার উপায় নেই। তবে এত অশান্তি, মারামারি চলতে থাকলে কত দিন উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে থাকতে পারব, জানি না। ভবিষ্যতে হয়তো পাকাপাকি ভাবে দেশেই ফিরতে হবে।
অনুলিখন: স্বর্ণাভ দেব