রামাল্লার উত্তরে ইজরায়েল এমনি ভাবেই দেওয়াল তুলেছে।
একটা দেওয়াল আর একটা পরিবার!
দেওয়ালটাই যেন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে পরিবারটাকে! আতঙ্ক সঙ্গী করেই দিন কাটাচ্ছে তারা। হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে যেতেও ভয় পিছু ছাড়ে না। কান পাতলেই শোনা যায়, ভারী বুটের আওয়াজ!
অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে রামাল্লার উত্তরে ইজরায়েল যে দেওয়াল তুলেছে, তার মধ্যে কোথাও কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। দেওয়ালটির এক দিকে প্যালেস্তিনীয়রা এবং অন্য দিকটায় ইজরায়েলিদের বসতি। খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, ওই দেওয়ালের মধ্যেই উঠোনের মতো এক ফালি ফাঁকা জায়গা। ওটা ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’। আর সেখানেই বাস জুমা পরিবারের। প্যালেস্তিনীয় হওয়া সত্ত্বেও রাস্তার ধার দিয়ে নতুন তৈরি ওই দেওয়ালের কিছুটা অংশ প্যালেস্তিনীয় শহর এল-বিরে থেকে আলাদা করে দিয়েছে ওই পরিবারটিকে। ফলে চরম আতান্তরে তারা। জুমা পরিবার জানিয়েছে, পাঁউরুটি, দুধ কিনতেও তাদের ইজরায়েলি চেকপয়েন্ট পেরোতে হয়। খেলার জায়গাও পায় না শিশুরা। অগত্যা ৬ মিটার ওই দেওয়ালের ছায়াতেই খেলে বেড়ায় পরিবারের খুদেগুলো। ওই দেওয়ালের গা ঘেঁষেই ছোট্ট আনাজের বাগান।
আট সন্তানের বাবা হোসাম জুমার কথায়, ‘‘ওই প্রাচীরটা প্যালেস্তাইন ও সেখানকার মানুষদের থেকে আমাদের আলাদা করে দিয়েছে। প্যালেস্তিনীয় হওয়া সত্ত্বেও মনে হয়, আমি ইজরায়েলেই। এখন আমরা একা।’’
প্রথম দিকে পরিস্থিতি এতটাও ঘোরালো ছিল না। ২০০২ সালে প্যালেস্তিনীয় হামলাকারীদের রুখতে ওই দেওয়াল তোলার কাজ শুরু করে ইজরায়েল। কিন্তু দু’-তিন বছর আগে জুমা পরিবার বুঝতে পারে, ওই দেওয়াল তৈরি হলে তারা নিজেদের দেশ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। এ কথা ইজরায়েল কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হলেও বিশেষ লাভ হয়নি। তবে গত বছর ৬ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুসালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করতেই দিকে দিকে শুরু হয় প্রতিবাদ। রাতারাতি আরও বাড়ানো হতে থাকে দেওয়ালটি। হোসামের ভাই হাকিমের কথায়, ‘‘দেওয়াল তৈরির কাজ আগে রাতেই হচ্ছিল। কিন্তু প্যালেস্তাইনে বিক্ষোভ ছড়াতেই দিনেও দেওয়াল তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়।’’
ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক কিন্তু অন্য কথা বলেছিল, দাবি জুমা পরিবারের। মন্ত্রক এক বিবৃতিতে জানায়, গোলাগুলির ঘটনা রুখতে দেওয়াল তোলা আবশ্যিক। কিন্তু ওই দেওয়ালটি কারও ব্যক্তিগত জমির ক্ষতি করবে না। কোনও বাড়িকে বিচ্ছিন্ন করবে না। অর্থাৎ ওই দেওয়ালের জন্য কোনও কিছুই বদলাবে না।
এই প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সব কিছু বদলে গিয়েছে জুমা পরিবারের। প্রথম থেকে দেওয়াল তোলার বিষয়টির বিরোধিতা করার কথা ওই পরিবারটিকে বলেছিলন প্যালেস্তিনীয় রাজনীতিবিদেরা। তাতেও বিশেষ সুবিধে হয়নি। তবে এখন তাঁরা দেওয়ালের অন্য ধারের বাসিন্দা। নিত্যনতুন আতঙ্ক ঘিরে থাকে তাদের। হোসাম বলেন, ‘‘১৯৯০ সালে এক হামলায় বাড়ির জানলাগুলি ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ বার যে হেতু দেওয়ালের ভিতরেই রয়েছি, ফলে যে কোনও মুহূর্তে হামলার আশঙ্কাটা থেকেই যাচ্ছে।’’
হতাশার চোরাবালির মধ্যে বসে হাকিম তাই বলেন, ‘‘আজ আমরা স্বাধীন। এখন থেকে নিজেদের ‘দ্য গ্রেট রিপাবলিক অব জুমা’ বলব।’’