ট্রাম্পের ঘোষণায় উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য ।
চাঁদের মতো এক ফালি ভূখণ্ড। সেখান থেকেই উঠে এসেছে জুডাইজম, ক্রিস্চানিটি ও ইসলাম। তিনটি ধর্ম বিশ্বাস। যে বিশ্বাসের সঙ্গে মিশে গিয়েছে ইতিহাস এবং অবশ্যই রাজনীতি। ধর্ম আর রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে তৈরি হয়েছে দীর্ঘ ঘটনা প্রবাহ। যে প্রবাহ অনেক রক্ত ঝরিয়েছে। অনেক আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ দেখেছে। এই পুরো প্রবাহের পথে কোনও একটি শহর যদি কেন্দ্রে থাকে, তা হলে তা জেরুসালেম। রোমান সাম্রাজ্য, ক্রুসেড— কত ঝড়ই না বয়ে গিয়েছে এ শহরের উপর থেকে। তিনটি ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই শহর। তিনটি ধর্মের পবিত্র স্থান রয়েছে এ শহরে। রয়েছে এই শহর নিয়ে তাঁদের দাবিও। এই প্রবাহটির আন্দাজ পেতে গেলে খুব পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। মেরেকেটে ১০০ বছর আগে গেলেই চলে।
১৯১৭-তে এমনই এক শীতার্ত ডিসেম্বরে ব্রিটিশ জেনারেল এডমন্ড অ্যালেনবি এসে পৌঁছলেন জেরুসালেমে। সদ্য অটোমান-তুর্কিদের হাত থেকে এ শহর জিতে নিয়েছে ব্রিটিশরা। তবে ঘোড়ায় চড়ে বিজয়ী বীরের মতো জয়োল্লাস করতে করতে নয়, ঘোড়া থেকে নেমে পায়ে হেঁটে জাফা গেট দিয়ে শহরে ঢুকলেন তিনি। এত দিন জেরুজালেম একটি পবিত্র ধর্মস্থান হলেও তা রাজধানীর স্বীকৃতি পায়নি। ব্রিটিশরা সেই স্বীকৃতিই দিল। আর তারই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল নতুন সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট। যে সংঘর্ষের এক দিকে রয়েছেন এই শহরের ভূমিপূত্র প্যালেস্তিনীয়রা। অন্য দিকে ইহুদিরা।
আরও পড়ুন: জেরুসালেম: অনড় ট্রাম্প, নিরপেক্ষ দিল্লি
ইতিহাসের শহর, যা এখন সংঘাতের কেন্দ্রে।
সারা ইউরোপ জুড়ে ইহুদি বিদ্বেষের তখন সবে সূচনা হয়েছে। ইউরোপের নানা জায়গায় নিজভূমে পরবাসী হতে থাকা এই ইহুদিদের কাছে, ব্রিটিশ শাসনে আসা প্যালেস্তাইনের আকর্ষণ এড়ানো তাই ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠল। পাশাপাশি ওই অঞ্চলের অধিকার তো আবার তাঁদের ধর্মমতে স্বীকৃত। ওখানেই ছিল তাঁদের দেশ। ফ্যারাওয়েরদের হাতে বন্দি ইহুদিদের বাঁচিয়ে মোজেস তো এই ভূমিতেই নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন তাঁদের। অতএব দলে দলে ইহুদি শরণার্থী ভিড় জমালেন প্যালেস্তাইনে, বিশেষ করে জেরুসালেম।
শরণার্থীদের ভিড় অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় মানুষজনের কাছে কাম্য থাকে না। প্যালেস্তাইনেও ছিল না। ১৫১৭ থেকে মুসলিম অটোমান শাসকদের অধীনে থাকা প্যালেস্তিনীয়দের কাছে অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি হল। ঠিক তার উল্টো প্রতিক্রিয়া ইহুদিদের মধ্যে। তাঁদের মধ্যে নিজেদের জন্য একটা দেশ তৈরির আকাঙ্খা তীব্র হতে থাকল। কিন্তু এই আকাঙ্খার পিছনে তখন ধর্মের থেকেও জাতীয়তা বোধ ছিল প্রবল। এর একটা কারণ, ইহুদিদের মধ্যে এই সময়ে যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন তাঁদের একটি বড় অংশ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা এই ইহুদিদের সঙ্গে প্যালেস্তিনীয়দের সংঘাতের ক্ষেত্র ক্রমেই তৈরি হচ্ছিল। তৈরি হচ্ছিল প্যালেস্তিনীয়দের নিজস্ব জাতীয়তাবাদ। যার নেতৃত্বে ছিল নামকরা প্যালেস্তিনীয় পরিবারগুলি। এত দিন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকার সুবিধা যাঁরা ভোগ করে এসেছেন। শুরু হয়ে গেল একের পর এক দাঙ্গা, রক্তপাত। পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ১৯৩৯-এ ইহুদিদের প্যালেস্তাইনে আসার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করল ব্রিটিশ প্রশাসন। এই নিষেধাজ্ঞার কারণেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অনেক ইহুদি আশ্রয়ের জন্য প্যালেস্তাইনে আসতে পারেননি।
ব্রিটিশ অধিকারে থাকাকালীন জেরুসালেম
এর পরে ১৯৪৭-এ দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বাধল। সমস্যা মেটাতে প্যালেস্তাইনকে দুই ভাগে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। এক ভাগের অধিকার পাবে ইহুদিরা। অন্য ভাগে আরব প্যালেস্তিনীয়রা। আর জেরুসালেম! তার জন্য স্পেশ্যাল স্ট্যাটাস। সে কোনও ভাগের অংশ হবে না। আন্তর্জাতিক একটি দল আলাদা ভাবে এই শহরের দেখভালের দায়িত্বে থাকবে। পরিকল্পনা মেনে নিতে অস্বীকার করল আরবরা। নিজেদের অধিকারে থাকা অঞ্চলকে পরের দিন স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করল ইহুদিরা। তৈরি হল ইজরায়েল। জেরুসালেমের পশ্চিম অংশের দখল থাকল তাদের হাতে। পূর্ব অংশ, যাঁর মধ্যে শহরের পুরনো অংশ, প্যালেস্তিনীয়দের হয়ে দখলে রাখল জর্ডন। লক্ষ লক্ষ প্যালেস্তিনীয় ঘরছাড়া হলেন।
আরও পড়ুন: জেরুসালেম ঘোষণা: ট্রাম্পের বিরোধিতায় বিশ্ব, ফুঁসছে প্যালেস্তাইন
মজার কথা হল, এর পরে বেশ কিছু দিন জেরুসালেমের অধিকারের জন্য দু’পক্ষ থেকেই তেমন দাবি ওঠেনি। জর্ডনের শাসক, রাজা প্রথম আবদুল্লা জেরুসালেমের থেকে নিজেদের রাজধানী আমানকে ঢেলে সাজতে অনেক বেশি ব্যস্ত ছিলেন। অন্য দিকে, আন্তর্জাতিক চাপে ইজরায়েলের শাসকরাও সে ভাবে জেরুজালেমকে নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। বরং তেল আভিভ, হাইফা, আসকালোন-এর মতো শহরে উন্নয়নের জোয়ার আনতেই ব্যস্ত ছিল। ইজরায়েলের প্রথম দু’দশকের শাসকদের মধ্যে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী নেতাদের সংখ্যা ও প্রভাব ছিল বেশি। এই নেতারা বুঝেছিলেন, জেরুসালেমের অধিকার পেলেও বা সেখানে রাজধানী বানালেও, কর্তৃত্ব বজায় রাখা বেশ শক্ত। আন্তর্জাতিক মহলও জেরুজালেম ভুলে, তেল আভিভে দূতাবাস খুলতে শুরু করে। তবে আরব-ইজরায়েল বিবাদ চলতেই থাকল।
গোলমাল বড় আকার নিল ১৯৬৭-র জুনে। মিশরের তৎকালীন শাসক নাসের তাইরান প্রণালী দিয়ে ইজরায়েলের জাহাজ যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। মিশর-ইজরায়েল সীমান্তে সেনা সমাবেশ করলেন। নাসেরের উদ্দেশ্য ছিল ভয় দেখানোর। কিন্তু হঠাৎ পাল্টা বিমানহানা চালিয়ে সব ওলোট-পালোট করে দেয় ইজরায়েল। সে হানায় নাসেরের পুরো বিমানবাহিনী কার্যত ধ্বংস হয়ে যায়। পাশাপাশি গাজা ও সিনাই-এ স্থলযুদ্ধ শুরু করে ইজরায়েল। এই অতর্কিত হানায় কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়ে মিশর। নাসেরের চেষ্টায় সিরিয়া ও জর্ডনও যুদ্ধ নামে। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ছ’দিনের যুদ্ধের শেষে ইজরায়েল মিশরের কাছ থেকে গাজা ও সিনাই দখল করে নেয়। জর্ডনের থেকে পূর্ব জেরুজালেম, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক আর সিরিয়ার কাছ থেকে গোলেন হাইটস দখল করে নেয়।
ইজরায়েলের দখলে থাকা আজকের জেরুসালেম
এই বিপুল জয় ইজরায়েলের মনস্তত্ত্ব পাল্টে দেয়। এখন আর কিছুই অসম্ভব নয়, এমন এক ধারণা তৈরি হয়। পাশাপাশি জেরুজালেম অধিকারে রাখা নিয়ে দাবি তীব্র হতে থাকে। এই জয়ের পরের পূর্ব জেরুসালেমে থাকা পবিত্র পশ্চিম দেওয়ালে প্রার্থনা করার সুযোগও মেলে। এই সুযোগ হারাতে ইজরায়েল আর রাজি ছিল না। একই সঙ্গে ইজরায়েলের রাজনীতিতেও দক্ষিণপন্থী নেতাদের দাপট বাড়তে থাকে। যাঁদের রাজনীতির মূল ভিত্তিটাই এই অঞ্চলের উপরে ধর্মীয় অধিকার স্থাপন করাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করে। যা আরও ইন্ধন পায় ১৯৭৩-এ।
সে বছরের অক্টোবরে ছ’দিনের যুদ্ধের শোধ তুলতে এক সঙ্গে আক্রমণ শানায় মিশর, সিরিয়া ও জর্ডন। হতচকিত হয়ে পড়ে ইজরায়েল। প্রথমে বেশ কিছু দখল করা এলাকার অধিকার হারাতে হয় তাদের। তার পর কিন্তু ইজরায়েল পাল্টা ঘুরে দাঁড়ায়। সাত দিন পরে দেখা যায়, দামাস্কাসের উপকণ্ঠে গোলাবর্ষণ করছে ইজরায়েলের গোলন্দাজ বাহিনী। আর সুয়েজ শহরে কোণঠাসা মিশরের সেনা।
আরও পড়ুন: ট্রাম্পের বিতর্কিত ঘোষণা: জেরুসালেম ইজরায়েলের রাজধানী
রাষ্ট্রপুঞ্জের মধ্যস্থতায় শান্তি ফিরলেও আরব মনস্তত্ত্বে এই হারের গভীর প্রভাব পড়ে। ঠিক উল্টোটা হয় ইজরায়েলে। ১৯৭৭-এ ভোটে জিতে প্রথম ক্ষমতায় আসে দক্ষিণপন্থী লিকুদ দল। প্রধানমন্ত্রী হন মিনাহেম বিগিন। এবং ইজরায়েলের অস্তিত্ত্বের সঙ্গে জেরুসালেমের অধিকার পাওয়া অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে যায়। সমাজতান্ত্রিক নেতাদের বদলে কড়া ও নরম দক্ষিণপন্থী নেতারাই ইজরায়েলের রাজনীতির ভিত্তি হয়ে ওঠেন। ১৯৮০-তে অখণ্ড জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইজরায়েল। যদিও পূর্ব জেরুজালেমকে পুরোপুরি করায়ত্ত করেনি তারা।
আহত প্যালেস্তিনীয় মনস্ত্বত্তের কাছেও জেরুজালেম ফিরে পাওয়া জয়ের সামিল। ১৯৯৩ সালে ওসলো শান্তি চুক্তিতে প্যালেস্তিনীয় প্রশাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা শাসনের অধিকার পায় তারা। কিন্তু জেরুজালেম নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। কারণ, ১৯৯৩-এর মতো শান্ত পরিস্থিতিতেও এই আগুনে হাত ছোঁয়ানোর সাহস দেখায়নি আমেরিকা, ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন। তার পর থেকে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হয়েছে। ২০০০ সালে আল-আস্কা মসজিদে বর্তমানে প্রয়াত নেতা অ্যারিয়েল শ্যারনের ঢোকা থেকে শুরু হয়ে প্যালেস্তিনীয়দের দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াই, ইনতিফাদা। পাঁচ বছরে তিন হাজার প্যালেস্তিনীয় ও এক হাজার ইজরায়েলির প্রাণ গিয়েছে এই যুদ্ধে। এই সময়েই গাজায় নিজের অধিকার শক্ত করেছে হামাস। তাদের রকেট হামলার মোকাবিলায় বার বার টানা বিমানহানা চালিয়েছে ইজরায়েল। প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সে শহর। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে প্যালেস্তিনীয় প্রেসিডেন্ট মামহুদ আব্বাসের সঙ্গে গাজায় হামাসের নেতৃত্বের সম্পর্ক কখনই স্থিতিশীল হয়নি। ফলে ঐক্যবদ্ধ প্যালেস্তিনীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রটিই গড়ে ওঠেনি।
একশো বছর পরে সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আরও ইন্ধন জোগালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আরও চওড়া হয়ে গেল বিরোধের খাদটি। আবার রাস্তায় নেমেছে প্যালেস্তিনীয়রা। আন্দোলন শুরু করেছে। দৃশ্যত খুশি ইজরায়েলও তা প্রতিরোধে নামবে। আর আন্তর্জাতিক মহল? রাষ্ট্রপুঞ্জের গর্ভগৃহে নতুন কোনও প্রস্তাব পাশ করে চেয়ে থাকবে।
ছবি: সংগৃহীত