ইজ়রায়েলি হানার মুখে ঘর ছাড়তে হয়েছে প্যালেস্টাইনি শিশুদের। দক্ষিণ গাজ়ার খান এক হাসপাতালে ছোট ভাই-বোনের দেখভালে ব্যস্ত এক শরণার্থী বালক। ছবি: রয়টার্স।
গাজ়ার ‘দুঃস্বপ্ন’ শেষ হোক। ফের ইজ়রায়েলের উদ্দেশে যুদ্ধবিরতির বার্তা দিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। যদিও তেমন কোনও লক্ষণ নেই। বরং যুদ্ধের গতি ক্রমেই বাড়াচ্ছে ইজ়রায়েল। গত কাল রাতে গাজ়ায় প্রবেশ করেছে আরও বৃহদাকার ইজ়রায়েলি স্থলবাহিনী। ঠিক কত সংখ্যক সেনা, তা খোলসা করেননি ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)-র মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি। তিনি এ-ও জানিয়েছেন, গত কাল হামাসের সাড়ে চারশো ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে তাঁদের যুদ্ধবিমান।
হাগারি কালই জানিয়েছিলেন, গাজ়ার উত্তর অংশে ছড়িয়ে পড়েছে ইজ়রায়েলি বাহিনী। বাসিন্দাদের বলা হচ্ছে, প্রাণ বাঁচাতে হলে দক্ষিণের দিকে চলে যেতে। আজ উত্তর গাজ়ার আল-কুয়াদ হাসপাতালও ফাঁকা করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইজ়রায়েল। এই নির্দেশে স্তম্ভিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র প্রধান টেড্রস অ্যাডানম গেব্রিয়েসাস। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘একটা হাসপাতাল, তাতে রোগী উপচে পড়ছে। এ অবস্থায় কী ভাবে তাঁদের অন্যত্র স্থানান্তরিত করা সম্ভব!’’ ইজ়রায়েলি বাহিনী এর কোনও জবাব দেয়নি।
এক দিকে স্থল-অভিযান চলছে। অন্য দিকে, একনাগাড়ে বিমান হানা। মিনিটে মিনিটে বিস্ফোরণে কেঁপে উঠছে গাজ়ার বিভিন্ন প্রান্ত। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আজ বলেন, ‘‘অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ হওয়া উচিত। বন্দিদের মুক্তি দেওয়া উচিত। কিন্তু তা না করে, ইজ়রায়েল আরও তীব্র গতিতে হামলা শুরু করেছে।’’ আজ একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে আইডিএফ জানিয়েছে, উত্তর গাজ়ায় স্থল-অভিযান চলছে। সেখানে হামাসের বন্দুকবাজদের মুখোমুখি হয়েছিল তারা। দু’পক্ষের গুলি বিনিময় চলে। শেষে সেনার গুলিতে তারা প্রাণ হারায়। টেলিগ্রাম পোস্টে আইডিএফ লিখেছে, ‘‘ইজ়রায়েলি সেনাবাহিনীকে নিশানা করে যে সন্ত্রাসবাদীরা গুলি চালিয়েছিল, তাদের হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া গাজ়া স্ট্রিপে জ়িকিম এলাকার কাছে উপকূলবর্তী অঞ্চলে যে সন্ত্রাসবাদীদের চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাদেরও শেষ করা হয়েছে।’’ হামাসের ইজ়েদিন আল-কাসাম ব্রিগেড-ও টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টে জানিয়েছে, উত্তর গাজ়ার বেট লাহিয়ার কাছে ইজ়রায়েলের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ চলেছে। হামাসের দাবি, ইজ়রায়েলি সেনাদের হত্যা করেছে তারা।
ইজ়রায়েলের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, তাদের দেশের কমপক্ষে ২৪০ জন গাজ়ায় হামাসের কোনও গোপন ডেরায় বন্দি রয়েছেন। যত দিন যাচ্ছে, তাঁদের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা কমছে। হামাস ইতিমধ্যেই দাবি করেছে, ইজ়রায়েলের বোমায় ৫০ জন বন্দি প্রাণ হারিয়েছে। এর সত্যতা জানা নেই। হামাসের হাতে বন্দি এক ইজ়রায়েলি তরুণী ইনবার হেম্যানের প্রেমিক নোয়াম বলেন, ‘‘এখন সরকারের হাতে সবটা। ওরা ঠিক করবে, ইনবার ফিরবে কি না। আমি আশা করি ওরা সব রকম চেষ্টা করবে। কারণ সরকার কিংবা রাজনীতিবিদ, সকলের এটাই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।’’ নোয়াম জানান, তিনি রাতে ঘুমোতে পারছেন না। তিন সপ্তাহ কেটে গিয়েছে, বন্দিদের সঙ্গে কী হচ্ছে, এটা ভেবে শিউরে উঠছেন তিনি। নোয়ামের কথায়, ‘‘আশা করি আইডিএফ ইজ়রায়েল ও প্যালেস্টাইনের সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করবে না।’’ আশার কথা বললেও নোয়ামের গলায় অবশ্য বিষণ্ণতার সুর। বলেছেন, ‘‘আমি শক্ত হওয়ার চেষ্টা করছি।’’
গত কাল ইন্টারনেট ও ফোন যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল গাজ়ায়। আজ সেটা কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু খাদ্য ও পানীয়ের সঙ্কট চরমে। হাজার হাজার মানুষ আজ একটি গুদামঘরে (ত্রাণসামগ্রী যেখানে মজুত করে রাখা ছিল) লুটপাট চালান। তাঁরা জানিয়েছেন, উপায় থাকলে তাঁরা কখনওই এ কাজ করতেন না। আব্দুলরহমান আল খিলানি নামে এক যুবক বলেন, ‘‘আমাদের কাছে আটা-ময়দা নেই, ওষুধ নেই, জল নেই। একটা শৌচাগার পর্যন্ত নেই। বাড়িঘর ভেঙে গিয়েছে। কেউ আমাদের দেখছে না। সব দেশ আমাদের বিরুদ্ধে। উপায় থাকলে কখনও লুটপাট করতাম না।’’ রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জানিয়েছে, গাজ়ার আইনশৃঙ্খলা ক্রমে ভেঙে পড়ছে। তবে কেউ জ্বালানি চুরি করেননি। মূলত আটা-ময়দা, শৌচসামগ্রী লুট হয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম’ (ডব্লিউএফপি)-এর এক শীর্ষস্থানীয় আধিকারিক আবির ইতেফা বলেন, ‘‘এটা প্রত্যাশিতই ছিল। ওঁরা অভুক্ত, ওঁরা তো বেপরোয়া হবেই।’’ ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হওয়া থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৮০টি ত্রাণের ট্রাক গাজ়ায় ঢুকতে দিয়েছে ইজ়রায়েল। যা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। গত কাল ইন্টারনেট ও ফোন যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায়, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল ডব্লিউএফপি। আজ ফের তা চালু করা হয়েছে।
সেন্ট্রাল গাজ়ার বাসিন্দা এক তরুণী ফোনে জানিয়েছেন, তিনি দক্ষিণ গাজ়ার খান ইউনিসে পালিয়ে এসেছেন। কিন্তু তাতেও মৃত্যুভয় যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘‘কোনও নিরাপদ জায়গা নেই। টানা বোমা পড়ছে। বাড়িগুলোর অবস্থা খুব খারাপ। যে কোনও সময় বাসিন্দাদের মাথাতেই ভেঙে পড়তে পারে। ঘুমোতে পারছি না, বিশ্রামের জায়গা নেই। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন।’’