মৃত্যুর আগে উৎকণ্ঠায় ভুগছিল বাগদাদি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ইরাকের মসুলে আল নুরিতে দাঁড়িয়ে একটা মাত্র জ্বালাময়ী ভাষণ। আর তাতেই সাড়া পড়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বে। পরিবার পরিজনদের ছেড়ে তার দলে ভিড়েছিল হাজার হাজার ছেলেমেয়ে। কোথাও আবার একাই রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিল কেউ কেউ। কিন্তু জীবনের শেষ দিনগুলিতে সেই প্রতাপ ধরে রাখতে পারেনি জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর নেতা আবু বকর আল-বাগদাদি। বরং সারা ক্ষণ শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াত তাকে। তাই মাঝেমধ্যেই মেষপালকের ভেক ধরত। তার সন্দেহ ছিল, যে কোনও সময়, যে কোনও দিক থেকে আক্রমণ আসতে পারে। মানসিক অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে খুব কাছের লোকদের প্রতিও অবিশ্বাস জন্মেছিল। বাগদাদির সহযোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এমনই তথ্য উঠে এল।
গত ২৬ অক্টোবর সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের বারিশা এলাকায় বাগদাদির ডেরায় হানা দেয় মার্কিন বাহিনীর অভিজ্ঞ ডেল্টা এবং ৭৫তম রেঞ্জার রেজিমেন্ট। অকস্মাৎ এই হামলায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে বাগদাদি। তিন সন্তানকে নিয়ে একটি সুড়ঙ্গের মধ্যে আশ্রয় নেয় সে। সেখানেই আত্মঘাতী জ্যাকেটের বোতাম টিপে তিন সন্তান ও নিজেকে উড়িয়ে দেয় বাগদাদি। সেই সময় তার কয়েক জন অনুচরও ওই ডেরায় ছিল। তাদের মধ্যে কয়েক জন মার্কিন সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যায়। আবার আত্মসমর্পণও করে কয়েক জন।
আত্মসমর্পণকারী ওই আইএস জঙ্গিরাই মার্কিন আধিকারিকদের বাগদাদির জীবনের শেষ দিনগুলির বর্ণনা দিয়েছে, যা সংবাদ সংস্থা এপি সূত্রে সামনে এসেছে। জানা গিয়েছে, মার্কিন যৌথ বাহিনীর লাগাতার হানায় ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল আইএস। তাদের দখলে থাকা একাধিক এলাকাও একে একে হাতছাড়া হচ্ছিল। তাতেই নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করেছিল বাগদাদিকে। ইরাক সীমান্তে পূর্ব সিরিয়ার যেটুকু অংশ তাদের হাতে বেঁচেছিল, সেখানেই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। একসময় নিজেকে ইসলামিক স্টেটের ‘খলিফা’ হয়ে উঠতে চাইলেও, শেষমেশ আলকায়দা-সহ প্রতিদ্বন্দ্বী জঙ্গি সংগঠনগুলির গড় উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার ইদলিবেই আস্তানা গাড়ে সে। হাতেগোনা কয়েক জন ছাড়া আর কারও সেখানে আসার অনুমতি ছিল না।
আরও পড়ুন: ভারতে আত্মঘাতী হামলার ছক কষেছিল আইএস খোরাসান গ্রুপ, দাবি শীর্ষ মার্কিন আধিকারিকের
সেই পরিস্থিতিতেই ইদলিবের ওই আস্তানায় একটি ইয়াজিদি কিশোরীকে বাগদাদি যৌনদাসী করে রাখে বলে জানা গিয়েছে। বিশ্বস্ত অনুচরদের সঙ্গে কোথাও গেলে, মেয়েটিকেও সঙ্গে নিয়ে যেত সে। এক বার চারমাসের জন্য দাশিসায় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। সেইসময় দাশিসাতেই নিজের শ্বশুরবাড়িতে ওই মেয়েটিকে রাখার বন্দোবস্ত করেছিল। অভিযোগ, মাঝে মধ্যে সেখানে গিয়ে ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করে আসত সে। গত মে মাসে ওই কিশোরীকে উদ্ধার করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন একটি বাহিনী। সংবাদ সংস্থা এপি-কে নিজে মুখে সে কথা জানিয়েছে ওই কিশোরী। তার দাবি, ২০১৭-য় ইদলিব ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল বাগদাদি। সেই মতো তিনটি গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। স্ত্রী, নিরাপত্তারক্ষী এবং ওই কিশোরীকে নিয়ে তাতে চেপে পালানোর চেষ্টা করে বাগদাদি। কিন্তু মার্কিন বাহিনীর হামলা করতে পারে ভেবে মাঝ রাস্তা থেকে ফিরে যায়। এর পরই ২০১৮-র বসন্তকালে ওই কিশোরীকে অন্য এক পুরুষের হাতে তুলে দেয় বাগদাদি। তার পর আর কখনও দেখা হয়নি তাদের মধ্যে। শুধুমাত্র এক বার তাকে একটি গয়না উপহার পাঠিয়েছিল কুখ্যাত ওই সন্ত্রাসবাদী।
গত সপ্তাহে সৌদি আরবের আল-আরবিয়া চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দেন বাগদাদির আত্মীয় মহম্মদ আলি সাজিদ। তিনি জানান, মৃত্যুর আগের কয়েক মাস সর্বদা উৎকণ্ঠায় ভুগত বাগদাদি। নিজের নিরাপত্তা নিয়েও আগের চেয়ে অনেক বেশি খুঁতখুঁতে হয়ে উঠেছিল। রাতের অন্ধকার ছাড়া বাইরে বার হত না। একান্তই বার হতে হলে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে, নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে তবেই যেত। সেইসময় তাকে ‘হাজি’ বা ‘শেখ’ বলেই ডাকত নিরাপত্তারক্ষীরা। এমনকি নিজের অনুচরদের প্রতিও অবিশ্বাস জন্মেছিল তার। যে কোনও মুহূর্তে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে বা আইএস জঙ্গি সেজে কেউ বাইরে থেকে দলে ঢুকে পড়তে পারে বলে সর্বদা আতঙ্কে ভুগত। তাই সর্বদা নিজের সঙ্গে আত্মঘাতী জ্যাকেট বা বেল্ট রাখত বাগদাদি। এমনকি ঘুমনোর সময়ও বিছানায় আত্মঘাতী বেল্ট রাখত, যাতে কোনও ভাবেই শত্রুপক্ষের হাতে না পড়ে যায়। নজরদারি এড়াতে মাঝেমধ্যে মেষপালকের ছদ্মবেশও নিত বাগদাদি। নিজে মোবাইল ব্যবহার না করলেও তা সহযোগীদের মধ্যে কেউ কেউ মোবাইল ফোন ব্যবহার করত।
আরও পড়ুন: বিষাক্ত গ্যাস ছড়াচ্ছে পাকিস্তান! দিল্লির দূষণ নিয়ে অভিযোগ বিজেপি নেতার
মহম্মদ আলি সাজিদের দাবি, সারা ক্ষণ উৎকণ্ঠায় ভুগত বাগদাদি। তার ডায়বেটিসের সমস্যাও আচমকা অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। তার জন্য সারা ক্ষণ ব্লাড সুগারের উপর নজর রাখতে হত। নিতে হত ইনসুলিনও। তবে এত কিছুর পরেও শেষরক্ষা হয়নি।