International News

সাঁড়াশি আক্রমণে দিশেহারা আইএস, কারও মোবাইলে সিম পেলেই গুলি বা গর্দান

মোবাইলের সিম থাকলেই শিয়রে সমন। হয় ফায়ারিং স্কোয়াড। নয়তো খাঁচায় আটকে জলে ডুবিয়ে দেবে। ভাগ্য আরও মন্দ থাকলে গর্দান। ঘেরাও হয়ে থাকা ইরাকি শহর মসুলের সাধারণ নাগরিকদের এটাই বাস্তব। এ ভাবে শুধু বেঁচে থাকাটাই যেখানে ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।

Advertisement

রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ১৩:২৪
Share:

ছবি: সংগৃহীত।

মোবাইলের সিম থাকলেই শিয়রে সমন। হয় ফায়ারিং স্কোয়াড। নয়তো খাঁচায় আটকে জলে ডুবিয়ে দেবে। ভাগ্য আরও মন্দ থাকলে গর্দান। ঘেরাও হয়ে থাকা ইরাকি শহর মসুলের সাধারণ নাগরিকদের এটাই বাস্তব। এ ভাবে শুধু বেঁচে থাকাটাই যেখানে ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।

Advertisement

মসুল ইরাকে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর শেষ ঘাঁটি। ২০১৪তে ইরাকের প্রথম বড় শহর হিসেবে মসুলেরই পতন হয়েছিল। তার পর থেকে প্রায় দু’বছর সেই শহরে আইএস রাজত্ব চলেছে। এখানের মূল মসজিদেই নিজেকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করে আবু-বকর আল বাগদাদি। এই শহর দখলে রাখা আইএস-এর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। ‘জেহাদি’ সম্মান রক্ষার জন্যও। উল্টো দিকে, এই শহরের দখল নেওয়া ইরাকি, কুর্দ ও আমেরিকার সমান প্রয়োজন। এতে আইএস মনোবল আরও ভেঙে পড়বে। সেই লক্ষ্যে ১৭ অক্টোবর অভিযান শুরু হয়।

মসুলের উত্তর, দক্ষিণ আর পূর্ব প্রান্ত ইতিমধ্যেই ঘিরে রেখেছে ইরাকের সরকারি সেনা ও কুর্দ পেশমেরগা বাহিনী। এ বার পশ্চিম মসুলের দিক থেকেও জঙ্গিদের কোণঠাসা করতে চাইছে ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়ারা। এই পথে এখনও সিরিয়া থেকে অস্ত্র ও নিত্যপ্রয়োজনীয় রসদ আসে। সেখানে আঘাত হানা শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন রাস্তা জুড়ে জলন্ত ট্রাকের সারি।

Advertisement

এটা জানাই ছিল মসুল দখলের লড়াই সহজ হবে না। জানা ছিল, মসুলকে বিচ্ছিন্ন করতে বেশি সময় না লাগলেও শহরের কেন্দ্রের দিকে যত এগনো যাবে ততই বাধা বাড়বে। বাস্তবে তাই ঘটেছে। আইএস তীব্র প্রতিরোধ তৈরি করেছে। পাশাপাশি এই অভিযানের বড় সমস্যা হল মসুলের সাধারণ নাগরিকরা। প্রায় ১০ লক্ষের বাস এ শহরে। শঙ্কা ছিল এই নাগরিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে আইএস। হচ্ছেও তাই।

সাঁড়াশি আক্রমণের সামনে পড়ে ক্রমেই দিশাহারা হয়ে পড়ছে আইএস। দিশাহার হয়ে পড়ছে বাগদাদিও। প্রতি দিন অবস্থান পাল্টে ফেলছে। এক রাস্তা দিয়ে দু’বার যাচ্ছে না। একই জায়গায় পর পর একাধিক রাত কাটাচ্ছে না। দ্রুত অবস্থান বদলে ফেলছে। ঘুমনোর সময়ে সুইসাইড বর্ম সঙ্গে রাখছে। যাতে কেউ ধরতে এলে বাগদাদির সঙ্গে তারও ভবলীলা সাঙ্গ হয়। যত সম্ভব মসুলেও আর থাকছে না বাগদাদি। সিরিয়ার সীমানা ঘেঁষা নিনেভ প্রদেশের বাজ-এ থাকছে। প্রায় ২০ হাজার বাসিন্দার বাজ-এ বরাবরই সুন্নি মৌলবাদীদের ঘাঁটি। সাদ্দামের পতনের পর থেকে বাজ জুড়ে ভূগর্ভস্ত টানেল তৈরি করা হয়েছিল। সেগুলিই কাজে লাগাচ্ছে আইএস। কিন্তু এ ভাবে অবস্থান বদল করায় জঙ্গিদের কাছে ঠিকমতো নির্দেশ পৌঁছচ্ছে না। বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।

আইএস আতঙ্কে মসুল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ছবি: রয়টার্স।

মসুল শহর জুড়েও চেকপোস্ট গড়ে তুলেছে আইএস। শহর জুড়ে টানেল তৈরি হয়েছে আইএস জঙ্গিদের লড়াইয়ের সুবিধার জন্য। কিন্তু ক্রমেই ভয় গ্রাস করছে আইএস এবং বাগদাদিকে। মসুলের অভিযানের আগে কুর্দ এবং ইরাকি সেনা সেখানে সোর্স তৈরি করেছে শত্রু সম্পর্কে আগাম তথ্য জোগাড় করার জন্য। তাঁদের থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, মসুলে আইএস-এর মধ্যে অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। কয়েক দিন আগেই বাগদাদি হত্যা করার এক চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যায়। আইএস-এর কয়েক জন উঁচু তলার নেতারা এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। সেই অভিযোগে প্রায় ৫২ জনকে হত্যা করা হয়।

দলের মধ্যে ও বাইরে চর, বিশ্বাসঘাতক খুঁজতে ব্যস্ত আইএস। বিশেষ করে যাদের কাছে মোবাইলের সিম পাওয়া যাচ্ছে তাদের পত্রপাঠ প্রাণ যাচ্ছে। মোবাইল মানেই শত্রুর কাছে যুদ্ধের পরিকল্পনা তুলে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। চেকপোস্টে নাগরিকদের তল্লাশি চালানো হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চলছে। যে সব জায়গায় মার্কিন বিমান হানা হয়েছে সেই সব জায়গায় নাগরিকদের জেরা করা হচ্ছে। আইএস-এর সন্দেহ, নাগরিকরাই বিমান হানার লক্ষ্য জানিয়ে দিচ্ছে। সামান্য সন্দেহের বশে হত্যা করা হচ্ছে। এ ভাবে প্রায় ৪২ জনের প্রাণ গিয়েছে। নিজের দলের লোকেরাও ছাড় পাচ্ছে না। ফলে আইএস-এর ভিতরেই পরস্পরের মধ্যে সন্দেহে বাড়ছে।

এই সন্দেহের অন্য কারণও রয়েছে। প্রায় এক বছর আগে তুরস্ক নিজের সীমান্ত সিল করে দেওয়ার পর থেকে বিদেশি জঙ্গিদের জোগান কমে গিয়েছে। অনেক বিদেশি জঙ্গি সংঘর্ষে মারা গিয়েছে। স্থানীয় জঙ্গিদের উপরে ভরসা করতে হচ্ছে। কিন্তু আইএস-এর নেতাদের আবার স্থানীয় জঙ্গিদের উপরে ভরসা নেই। স্থানীয় জঙ্গিরা সে ভাবে জঙ্গি মতাদর্শে অনুপ্রাণিত নয় বলে সন্দেহ তাদের। ফলে চর হিসাবে লাগানো হয়েছে ছোটদের। সেই দলের নাম ‘আশবাল আল খিলাফা’। ঘরে-বাইরে কান পাতার দায়িত্ব তাদের। তার পরে নেতাদের কানে কথা তুলে দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ। কিন্তু এতে বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে। প্রচুর খবর আসছে। যার সত্যাসত্য বিবেচনা করার সময় ও ধৈর্য আইএস-এর নেই। ফলে অকারণে হত্যা চলেছে। দুর্বল হয়ে পড়ছে প্রতিরোধ।

কিন্তু তার পরেও মসুল জেতা সহজ হবে না বলেই মনে করছেন ইরাকি ও কুর্দ কর্তৃপক্ষ। তাঁরা জানান, প্রায় ২০ হাজার আত্মঘাতী জঙ্গি তৈরি করে রেখেছে আইএস। ঢেউ-এর মতো তারা সেনার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ফলে সেনাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলতে হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। এখানেই শেষ নয়, তাঁদের আশঙ্কা মসুলের পতনের পরে আইএস গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতি নেবে। ইরাক জুড়ে চোরাগোপ্তা হামলা শুরু হবে। সে ক্ষেত্রে এই আত্মঘাতী বাহিনী কাজে লাগবে।

আরও পড়ুন

সাংবাদিকরা অসৎ, আক্রমণে ট্রাম্প

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement