আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানি চলাকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার আইনি দলের সদস্যের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের এক আইনজীবী। শুক্রবার। ছবি: রয়টার্স।
গণহত্যা আটকানোর কথা বললেও সংঘর্ষ-বিরতি বা অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের কথা শোনা গেল না আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারপতিদের মুখে।
গাজ়া ভূখণ্ডে গত কয়েক মাস ধরে ইজ়রায়েলি বাহিনী যে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, তা গণহত্যার সমান— এই মর্মে দ্য হেগ-এর আন্তর্জাতিক আদালতের (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা আইসিজে) দ্বারস্থ হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তারা বলেছিল, অবিলম্বে যেন গাজ়া ভূখণ্ডে সংঘর্ষ-বিরতির নির্দেশ দেয় আন্তর্জাতিক আদালত। আজ রাষ্ট্রপুঞ্জের সর্বোচ্চ এই আদালতের ১৫ জন বিচারপতি তাঁদের অন্তর্বর্তী রায়ে জানিয়েছেন, গণহত্যা রুখতে অবিলম্বে যাবতীয় পদক্ষেপ করতে হবে ইজ়রায়েল সরকারকে। গণহত্যায় ইন্ধনের কোনও ঘটনা ঘটলে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। গাজ়ায় বর্তমানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গাজ়ার সাধারণ মানুষদের জন্য খুব শীঘ্রই মানবিক সাহায্য ও ত্রাণ পাঠাতে হবে। এর পাশাপাশি, গণহত্যার কোনও প্রমাণ পাওয়া গেলে তা সংরক্ষণ করে ইজ়রায়েলকে এক মাসের মধ্যে আদালতকে রিপোর্ট দিয়ে জানাতে হবে, তারা নির্দেশ মেনেছে। কিন্তু আপাতত গাজ়া ভূখণ্ডে সামরিক অভিযান বন্ধ করা বা সংঘর্ষ-বিরতির কোনও নির্দেশ দেননি বিচারপতিরা। এই রায় নিয়ে তাই তোলপাড় শুরু হয়েছে গোটা দুনিয়ায়।
দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার যদিও এই রায়কে তাদেরই নৈতিক এবং কূটনৈতিক জয় বলে আখ্যা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, গাজ়ায় যে ইজ়রায়েলি বাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে, আজকের রায়ে তা কার্যত মেনে নিয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত। এই রায় আসলে ‘মানবিকতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের জয়’ বলে মনে করছেন প্যালেস্টাইনের বিদেশমন্ত্রী রিয়াদ আল-মালিকি। আইসিজে-র রায় যাতে ইজ়রায়েল মেনে চলে, সেই পরামর্শ দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অবশ্য কোনও সার্বভৌম দেশের উপরেই বাধ্যতামূলক ভাবে কার্যকর করা যায় না। এ ক্ষেত্রে ইজ়রায়েল সরকারও এই রায় কতটা মেনে চলবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এর আগে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ সামরিক অভিযান বন্ধের যে নির্দেশ আন্তর্জাতিক আদালত দিয়েছিল, তা-ও কখনও মেনে নেয়নি ভ্লাদিমির পুতিন সরকার। যার ফলে ইউক্রেন-রাশিয়া সামরিক দ্বন্দ্ব এখনও অব্যাহত।
ইজ়রায়েল সরকারও খোলাখুলি আজ দাবি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে কার্যত পরাজয় হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার। গণহত্যার অভিযোগ প্রথম থেকেই অস্বীকার করে এসেছে ইজ়রায়েল। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায়ের পরেও জানিয়ে দিয়েছেন, হামাসকে পুরোপুরি নিকেশ না করা পর্যন্ত গাজ়া ভূখণ্ড-সহ প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের বাহিনী সামরিক অভিযান চালিয়ে যাবে। তাঁর কথায়, ‘‘আন্তর্জাতিক আইন মেনেই নিজেদের দেশ এবং নাগরিকদের রক্ষা করে যাব আমরা।’’ ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রীর এক সিনিয়র উপদেষ্টা মার্ক রেজেভ বলেছেন, ‘‘আন্তর্জাতিক আদালতে কার্যসিদ্ধি হল না দক্ষিণ আফ্রিকার।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, গত বছরের ৭ অক্টোবর তাঁদের দেশের উপরে হামাস যে আক্রমণ চালিয়েছিল, তাতে রাষ্ট্রপুঞ্জের বেশ কিছু ত্রাণকর্মীরও হাত ছিল বলে ইজ়রায়েলি গোয়েন্দারা জানিয়েছিলেন। এ নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের অবিলম্বে তদন্ত শুরু করা উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন মার্ক।
প্যালেস্টাইনকে সমর্থন জানিয়ে গত কয়েক মাস ধরে আরব সাগর ও লোহিত সাগরে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক জাহাজের উপরে হামলা চালাচ্ছে ইয়েমেনের হুথি জঙ্গি গোষ্ঠী। ইরানের মদতেই হুথি সদস্যেরা ক্রমাগত এই হামলা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির। সম্প্রতি ইয়েমেনের বিভিন্ন শহরে হুথি ঘাঁটিকে নিশানা করে হামলা শুরু করেছে আমেরিকা ও ব্রিটেনের সামরিক বাহিনী। এ বার শোনা যাচ্ছে, খুব সম্প্রতি হুথি জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ করতে ইরানকে চাপ দিয়েছে তাদের বন্ধু দেশ চিন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু ইরানি আধিকারিক এই খবরের সত্যতাও স্বীকার করে নিয়েছেন। চিন বা ইরান সরকার এ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে। তবে শোনা যাচ্ছে, চিনা জাহাজে হুথি জঙ্গিদের হামলা হলে তেহরানের সঙ্গে তারা বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে বেজিং। তেহরানের নির্দেশে হুথি আদৌ তাদের হামলা থামায় কি না, সেটাই এখন দেখার।