কাবুলের গেস্টহাউসের বাইরে পাহারায় আফগান নিরাপত্তা রক্ষীরা। ছবি: এপি।
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি হায়দরাবাদ হাউসে নরেন্দ্র মোদীকে পাশে নিয়ে সন্ত্রাস-বিরোধিতার কথা বলেছিলেন। তার ১৫ দিনের মধ্যেই আফগানিস্তানে ফের আক্রান্ত হল ভারত। গত কাল রাতে কাবুলের গেস্টহাউসে হামলায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অমর সিন্হাই মূল লক্ষ্য ছিলেন বলে নিশ্চিত নয়াদিল্লি। আফগানিস্তানে ভারতকে রক্তচক্ষু দেখাতেই ওই হামলা বলে মনে করছে সাউথ ব্লক। পাশাপাশি ওই ঘটনার দায় স্বীকার করেছে তালিবান।
অমর সিন্হা যে হামলার লক্ষ্য হতে পারেন, সে কথা প্রথমে জানায় আফগান সরকারই। দিল্লিতে আফগান দূত শাইদা মহম্মদ আবদালি জানান, তাঁর সঙ্গে অমর সিন্হার কথা হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে ভারতীয় দূতের থাকার কথা ছিল। তিনি হামলার লক্ষ্য হতে পারেন। কাবুল থেকেও একই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। পরে সেই আশঙ্কা সমর্থন করে নয়াদিল্লিও। আজ অমর সিন্হা জানিয়েছেন, ‘‘এই ধরনের সন্ত্রাস আফগানিস্তানের পাশে দাঁড়ানোর প্রশ্নে আমাদের সংকল্পকে আরও দৃঢ় করবে।’’
ঘটনাটি ঠিক কী ঘটেছিল?
কাবুল শহরের কোলোলা পুশতা এলাকার পার্ক প্যালেস গেস্টহাউসে গত রাতে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। তাতে গান গাইবার কথা ছিল জনপ্রিয় আফগান গায়ক আলতাফ হোসেনের। আফগান, তুর্কি ও ভারতীয় আমন্ত্রিতদের তালিকায় ছিলেন রাষ্ট্রদূত অমর সিন্হাও। রাত ন’টা নাগাদ সেখানে হামলা চালায় তিন জঙ্গি। তাদের সঙ্গে সারা রাত লড়াই চলে আফগান জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর। প্রায় সাত ঘণ্টা লড়াইয়ের পরে আজ ভোরে মৃত্যু হয় তিন জঙ্গির। হামলায় ৪ জন ভারতীয়-সহ ১৪ জন নিহত হয়েছেন। অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত কোলোলা পুশতায় বহু আন্তর্জাতিক গেস্ট হাউস এবং হোটেল রয়েছে। কাছেই আফগান অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের অফিস।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখন চিনে। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও বিদেশ মন্ত্রকের শীর্ষ অফিসাররাও। সেখান থেকেই পরিস্থিতির খোঁজ নিয়েছেন তিনি। এটিকে কার্যত ভারতের বিরুদ্ধে তালিবানি ছায়াযুদ্ধ বলে মনে করছে নয়াদিল্লি। ভারতীয় গোয়েন্দাদের মতে, এর পিছনে সর্বতোভাবে ইন্ধন রয়েছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই ও পাক তালিবানের বড় অংশের।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘আশরাফের ভারত সফরের ঠিক পরেই আফগানিস্তান যান পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। আফগানিস্তানে ভারতের সঙ্গে ঠান্ডা লড়়াইয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে কাবুলের সঙ্গে নিরাপত্তা ও সামরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন পাক প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-এর অফিসারদের সরাতে বার বার কাবুলকে চাপ দেয় পাকিস্তান।’’ ইসলামাবাদের দাবি, আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে বড় নেটওয়ার্ক চালাচ্ছে ‘র’। করাচি-সহ পাকিস্তানের কয়েকটি এলাকায় জঙ্গি হানায় ‘র’-এর চরদের গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও দাবি পাকিস্তানের। এই পরিস্থিতিতে কাবুলে ভারতীয় দূতকে লক্ষ্য করে হামলা আফগানিস্তানে ভারতীয় প্রভাব শেষ করার পাক চেষ্টা বলেই মনে করছেন গোয়েন্দারা। যে ৪ জন ভারতীয় জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে দু’জন পেশায় অডিটর এবং এক জন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী। তাছাড়া এক মার্কিন, এক ইতালীয় এবং এক কাজাখ নাগরিক নিহত হয়েছেন। বাকি নিহতেরা আফগান। জখম ৬ জন।
সাম্প্রতিক অতীতেই ভারতকে লক্ষ্য করে আফগানিস্তানে কয়েকটি হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা। গত বছরের মে মাসে হেরাটে ভারতীয় কনসুলেটে হামলা হয়। আইটিবিপি ও আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে চার জঙ্গি নিহত হয়। তবে কনসুলেটের কর্মী বা তাঁদের পরিবারের কেউ হতাহত হননি।
২০১৩ সালের অগস্টে জালালাবাদের ভারতীয় কনসুলেটে বিস্ফোরণে প্রাণ হারান ছয় শিশু-সহ ন’জন। ২০০৮ এবং ২০০৯ সালে খাস কাবুলের ভারতীয় দূতাবাসে হামলায় মৃত্যু হয় মোট ৭৫ জনের। বারবার এ ভাবেই ভারতকে আফগানিস্তান ছাড়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করে সাউথ ব্লক।
মনমোহন সিংহের জমানা থেকেই ভারতকে আফগানিস্তান ছাড়া করার চেষ্টা শুরু করেছিল পাকিস্তান। কিন্তু তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ভারসাম্য রেখে চলেছিলেন। ভারত-বন্ধু হিসেবে পরিচিত কারজাইয়ের সঙ্গে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সখ্য ছিল। কিন্তু আশরাফ ঘানি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে পরিস্থিতি বদলেছে বলে মনে করছে সাউথ ব্লক। বিদেশ মন্ত্রকের মতে, ঘানি পাকিস্তান-পন্থী। তাই গদিতে বসার পরেই তিনি ইসলামাবাদ সফরে যান। কিন্তু ভারতে আসতে সময় নিয়েছেন ছ’মাস। ঘানির সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক এতটাই আড়ষ্ট হয়ে যায় যে, ভারতে আসার আগে স্ত্রীকে পাঠিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা সহজ করার চেষ্টা করেন তিনি।
রাষ্ট্রদূত অমর সিন্হা।
আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে বড় ভূমিকা নিয়েছে ভারত। এ বছরেই আফগানিস্তান যাওয়ার কথা আছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। কাবুলে পার্লামেন্টের ভবন তৈরি করে দিয়েছে নয়াদিল্লি। সেই ভবন উদ্বোধনে হাজির থাকার কথা প্রধানমন্ত্রী মোদীর। সেই সঙ্গে বামিয়ানে সার্ক গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরিতেও সাহায্য করছে ভারত। গোয়েন্দাদের মতে, আশরাফ ঘানি সরকারের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক সহজ হওয়ায় উদ্বিগ্ন আইএসআই-পাক জঙ্গি চক্র। তাই ভারতকে ফের কাবুল ছাড়া করার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে তারা।