আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালতে বিচারপতি আব্দুলওয়াকি আহমেদ ইউসুফের (বাঁ দিকে) রায়ের দিকেই নজর ভারতীয় প্রতিনিধিদের। (ইনসেটে কুলভূষণ যাদব) বুধবার। ছবি: পিটিআই।
পাকিস্তানে ভারতের হয়ে চরবৃত্তিতে অভিযুক্ত কুলভূষণ যাদবের মামলায় বড় জয় পেল ভারত। পাক সামরিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পুনর্বিবেচনা করতে পাকিস্তানকে নির্দেশ দিয়েছে দ্য হেগের আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালত। সেই রায় পুনর্বিবেচনার আগে পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড স্থগিত থাকবে। পাশাপাশি ভারতীয় কূটনীতিকদের যাদবের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে দ্য হেগের আদালত।
১৬ সদস্যের বেঞ্চের ১৫ জন সদস্য এই রায়ের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আন্তর্জাতিক আদালতের ভাইস প্রেসিডেন্ট চিনা বিচারপতিও। বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন কেবল পাকিস্তানি বিচারপতি তাসাদুক হুসেন জিলানি।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় নৌসেনার প্রাক্তন অফিসার কুলভূষণকে গ্রেফতার করে পাক বাহিনী। পাকিস্তান দাবি করে, বালুচিস্তানে জঙ্গি কার্যকলাপে মদত দেওয়ার সময়ে কুলভূষণ গ্রেফতার হয়েছেন। পাক সামরিক আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ভারত পাল্টা দাবি করে, ইরানে কুলভূষণের ব্যবসা আছে। তাঁকে সেখান থেকে অপহরণ করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
২০১৭ সালের ৮ মে ভারত কুলভূষণ কাণ্ড নিয়ে দ্য হেগের আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালতের দ্বারস্থ হয়। কুলভূষণের মৃত্যুদণ্ডে স্থগিতাদেশ দেয় আন্তর্জাতিক আদালত। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুলওয়ামা হামলা-পরবর্তী উত্তপ্ত পরিবেশে আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালতে সওয়াল করেন ভারত ও পাকিস্তানের কৌঁসুলিরা। ভারতের কৌঁসুলি হরিশ সালভে জানান, ভিয়েনা সনদ লঙ্ঘন করে ভারতীয় কূটনীতিকদের কুলভূষণের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি পাকিস্তান। পাশাপাশি পাক সামরিক আদালতের কাজের পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। মৃত্যুদণ্ড খারিজ করে কুলভূষণকে দেশে ফেরত পাঠানোর আর্জি জানান সালভে। পাক কৌঁসুলি খাওয়র কুরেশি পাল্টা সওয়ালে জানান, এ নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার এক্তিয়ারই নেই ভারতের। যাদব চরবৃত্তিতে যুক্ত ছিলেন বলেই ভারতীয় কূটনীতিকদের তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।
২০১৯
• ভারতের পক্ষে ছিলেন ভারতের প্রাক্তন সলিসিটর জেনারেল হরিশ সালভে, বিদেশ মন্ত্রকের যুগ্মসচিব দীপক মিত্তল।
• পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খাওয়ার কুরেশি এবং অ্যাটর্নি জেনারেল আনওয়ার মনসুর খান।
• আন্তর্জাতিক আদালতের ১৫ সদস্যের বেঞ্চে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি দলবীর ভাণ্ডারী থাকায় আনা হয় পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি তাসাদুক হুসেন জিলানিকে। আছেন সোমালিয়া, চিন, আমেরিকা, রাশিয়া, স্লোভাকিয়া, জাপান, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, ফ্রান্স, উগান্ডা, জামাইকা, লেবানন, অস্ট্রেলিয়া, মরক্কোর প্রতিনিধিরাও।
ভারতের যুক্তি
• জোর করে আদায় করা জবানবন্দির ভিত্তিতে রায়।
• ভিয়েনা সনদ লঙ্ঘন করে কুলভূষণের সঙ্গে ভারতের হাইকমিশনের আধিকারিককে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।
• পাক সামরিক আদালতের রায় বাতিল করা হোক।
• কুলভূষণকে মুক্তি দিয়ে ভারতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হোক।
• তা না-হলেও সামরিক আদালতের রায় বাতিল হোক। পাকিস্তান যেন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না-করে।
• আইন মেনে অসামরিক আদালতে মামলা শুরু হোক। কুলভূষণের সঙ্গে ভারতের আধিকারিকদের দেখা করতে দেওয়া হোক।
পাকিস্তানের পাল্টা
• ভারতের দাবি গ্রহণযোগ্যই নয়।
• চরবৃত্তির প্রমাণ আছে।
• চরবৃত্তিতে জড়িত বলেই হাইকমিশনের অফিসারদের দেখা করতে দেওয়া হয়নি।
• পাকিস্তানের সামরিক আদালতে অভিজ্ঞতা এবং আইনের জ্ঞানসম্পন্ন অফিসার নেই, এই সওয়াল ভিত্তিহীন।
• আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে না ভারত।
• পাকিস্তানে আইনি সহায়তা নিতেই পারেন কুলভূষণ।
আন্তর্জাতিক আদালতের রায় মানা কি বাধ্যতামূলক
• রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদের ৯৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রায় মানতে হবে।
• রায়ের ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ হলে আদালতকে তা ব্যাখ্যার অনুরোধ করা যেতে পারে। নতুন তথ্য জানা গেলে রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি জানানো যেতে পারে।
• তা সত্ত্বেও ১৯৮৬ সালে নিকারাগুয়ার সঙ্গে বিরোধের ক্ষেত্রে রায় মানেনি আমেরিকা।
কী হল তিন বছরে
২০১৬
৩ মার্চ: ধৃত কুলভূষণ যাদব।
২৪ মার্চ: পাকিস্তানের দাবি, ভারতের ‘গুপ্তচর’ কুলভূষণকে বালুচিস্তান থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
২৫ মার্চ: ভারতকে আনুষ্ঠানিক ভাবে তা জানানো হয়। পাক দাবি খারিজ ভারতের।
২৬ মার্চ: ভারতের বক্তব্য, প্রাক্তন নৌসেনা অফিসার কুলভূষণের ব্যবসা রয়েছে ইরানে। তাঁকে বালুচিস্তান থেকে গ্রেফতারের প্রমাণ নেই।
২৭ মার্চ: কুলভূযণের সঙ্গে হাইকমিশনের অফিসারদের দেখা করতে দেওয়ার অনুমতি চাইল দিল্লি। পরেও ১৬ বার ভারতের আর্জি খারিজ।
২০১৭
১০ এপ্রিল: কুলভূষণকে মৃত্যুদণ্ড পাকিস্তানের সেনা আদালতের।
১৪ এপ্রিল: মামলার সবিস্তার নথি চাইল ভারত।
২৭ এপ্রিল: যাদবের পরিবারের জন্য ভিসা চেয়ে চিঠি ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের।
৮ মে: পাক আদালতের
রায়ের বিরুদ্ধে দ্য হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস) গেল ভারত।
৯ মে: আইসিজে-তে মৃত্যুদণ্ড স্থগিত।
১৬ জুন: আইসিজে ভারতকে ১৩ সেপ্টেম্বর আর পাকিস্তানকে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে বক্তব্য জমা দিতে বলল।
২২ জুন: পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে প্রাণ বাঁচানোর আর্জি যাদবের।
৮ ডিসেম্বর: পাকিস্তান জানাল, ২৫ ডিসেম্বর যাদবের সঙ্গে মা এবং স্ত্রীকে দেখা করতে দেওয়া হবে।
২৫ ডিসেম্বর: দেখা হল।
২০১৮
আইসিজে জানাল, ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে চার দিনের শুনানি হবে।
২০১৯
১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে চার দিনের শুনানি (তার আগেই ঘটেছে পুলওয়ামা হামলা)।
আজ আন্তর্জাতিক আদালতের প্রেসিডেন্ট সোমালিয়ার বিচারপতি আব্দুলওয়াকি আহমেদ ইউসুফের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে জানায়, ভারতের আর্জি গ্রহণযোগ্য। পাকিস্তান ভিয়েনা সনদ লঙ্ঘন করেছে। ভারতীয় কূটনীতিকদের কুলভূষণের সঙ্গে দেখা করতে দিতে হবে। তাঁর আইনি প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থাও করতে হবে। পুনর্বিবেচনা করতে হবে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ।
তবে কুলভূষণকে মুক্তি দেওয়া বা তাঁকে ভারতে ফেরত পাঠানো নিয়ে ভারতের আর্জি মানতে রাজি হয়নি দ্য হেগের আদালত। রায়ের অংশ উদ্ধৃত করে কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালার বক্তব্য, ‘‘রায়কে স্বাগত জানাই। কিন্তু কুলভূষণের ফেরা নিশ্চিত হয়নি। পাকিস্তানের বেছে নেওয়া মঞ্চে ফের তাঁর বিচার হবে। তিনি ফের অবিচারের শিকার হতে পারেন। রায়ের এই অংশের পুনর্বিবেচনার আর্জি জানাতে সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’’ রায়কে স্বাগত জানিয়েছে ভারত। পাকিস্তান জানিয়েছে, তারা আইন মেনে চলবে।