পুণ্যার্থীদের মৃতদেহের সারি। বৃহস্পতিবার সৌদি আরবের মিনায় এপি-র ছবি।
১৫০, ৩০০, ৪৫৩, ৭১৭...।
দু’সপ্তাহ আগের মক্কার বিভীষিকা কাটতে না কাটতেই আজ ফের বিপর্যয়। এ বার মিনায়। পবিত্র জমরাত ব্রিজে ঢোকার মুখে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হল শ’য়ে শ’য়ে হজযাত্রীর।
দিনভর ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়তে থাকল মৃতের সংখ্যা। এখনও পর্যন্ত খবর, পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন ৭১৭ জন হজযাত্রী। এর মধ্যে রয়েছেন চার ভারতীয়। জখম ৮৬৩ জনের মধ্যেও আছেন দুই ভারতীয়। তাঁরা অসমের বাসিন্দা।
ঠিক কী ঘটেছিল আজ?
মক্কা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে মিনার পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকা। পবিত্র ইদ আল-আধা-র প্রথম দিন ছিল আজ। ঘড়িতে তখন সকাল ১০টা। শহরের ২০৪ ও ২২৩ স্ট্রিট ধরে জমরাত ব্রিজের দিকে যাচ্ছিলেন কাতারে কাতারে মানুষ। হঠাৎই ২২৩ ও ২০৪ স্ট্রিটের মোড়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। এক দল লোক জমরাতের দিকে যাচ্ছিলেন। ভিড়ের মধ্যেই অন্য একটি দল উল্টো দিক থেকে আসতে থাকে। শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে এক দল ছোটে ব্রিজের উদ্দেশে। অন্য দল ছোটে উল্টো দিকে। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পদপিষ্ট হয়ে যান শ’য়ে শ’য়ে মানুষ। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে, প্রাণে বাঁচতে এক-এক জন অন্য জনের ঘাড়ে-কাঁধে উঠে পড়েন। তাতে বিপদ বাড়ে আরও।
মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার। তার পরেই দেখা যায়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ। পাশে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন পরিজন। কেউ বা আল্লার নাম করে চলেছেন। কোথাও আবার দেখা যায়, স্তূপাকৃতি হয়ে পড়ে রয়েছে শ’খানেক দেহ। সৌদি প্রশাসন জানিয়েছে, মৃতদের অধিকাংশই নাইজেরিয়া, চাদ ও সেনেগালের বাসিন্দা।
প্রতি বছর বিশ লাখেরও বেশি পুণ্যার্থী মিনা হয়ে গ্র্যান্ড মসজিদে কাবা-র উদ্দেশে হজ করতে যান। মিনা-র এই জমরাতেই রয়েছে তিনটি পাথরের স্তম্ভ, যার নাম জমরাত আল আকাবা। প্রথা অনুযায়ী ওই স্তম্ভ লক্ষ্য করে শয়তানের উদ্দেশে সাত বার পাথর ছুড়ে মারেন পুণ্যার্থীরা।
ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, আর্থিক সামর্থ্য থাকলে জীবনে অন্তত এক বার মক্কায় হজ করতে যাওয়া উচিত। মরু-শহরে এ সময়ে তাই প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার বাতানুকূল তাঁবু পড়েছে। আপাতত সেগুলোই হজযাত্রীদের ঠিকানা।
হজের এই অংশটাই সবচেয়ে কঠিন। সূর্যোদয়ের পরই জমরাতের উদ্দেশে রওনা দেন সকলে। যেমন হয়েছিল আজ সকালে। ভোর থেকেই লাখখানেক মানুষ জড়ো হয়ে যান জমরাত ব্রিজে। তাই মাঝেমধ্যেই বিপর্যয় ঘটে। সেই কারণে বয়স্ক মানুষদের ওই সময়টা এড়িয়ে গিয়ে সন্ধ্যায় যেতে অনুরোধ করা হয় প্রশাসনের তরফে। সৌদি প্রশাসনের দাবি, এ বারও যথেষ্ট সতর্কতা নেওয়া হয়েছিল। তবু শেষ রক্ষা হয়নি।
জেড্ডায় ভারতীয় কনসাল জেনারেল বি এস মুবারক ফেসবুকে প্রথমে জানিয়েছিলেন, ভারতীয়রা নিরাপদে আছেন। মৃতদের অধিকাংশ আফ্রিকান ও আরবি। মিনার শহরের ওই অঞ্চলের তাবুতে তাঁরাই থাকতেন। ভারতীয়রা মূলত সুক আল আরব স্ট্রিট এবং জওহারা স্ট্রিটে থাকেন। যদিও পরে মুবারকই জানান, চার জন ভারতীয়ের মৃত্যুর খবর মিলেছে। এর মধ্যে এক জন হায়দরাবাদের বাসিন্দা। আর এক জন কেরলের। বাকি দু’জনকে শনাক্ত করা গেলেও সরকারি ভাবে পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।
মুবারক আরও বলেন, ‘‘মিনা এবং মক্কার সমস্ত সরকারি হাসপাতালে আমাদের চিকিৎসকেরা তৈরি আছেন। পরিস্থিতির উপরে নজর রাখা হচ্ছে। সৌদি সরকারের সঙ্গেও আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। খবর পেলেই হতাহত ভারতীয় হজযাত্রীর বিষয়ে সবিস্তার জানানো হবে।’’ ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, মৃত হজযাত্রীদের দেহ সৌদি স্বাস্থ্য সংস্থার মর্গে রাখা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সরকারি কাজকর্মের পরে তাঁদের পরিচয় এবং ছবি প্রকাশ করা হবে।
মিনাতে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০০৬ সালে এই জমরাত ব্রিজের কাছেই পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিলেন ৩৬৪ জন। ’৯৭ সালে তাঁবুতে আগুন লেগে মৃত্যু হয়েছিল ৩৪০ জনের। ’৯৪ সালেও এ ভাবেই ২৭০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তবে মৃতের সংখ্যার বিচারে সব চেয়ে ভয়াবহ ছিল ১৯৯০ সালটা। সে বার পদপিষ্ট হয়ে ১৪২৬ জন মারা যান।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে কেন বার বার একই ভাবে বিপর্যয় ঘটছে? বিশেষ করে মাত্র দু’সপ্তাহ আগে যখন মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদে ক্রেন ভেঙে পড়ে ১১৫ জনের মৃত্যু হল। সৌদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী খালেদ আল-ফালির বক্তব্য, এ বার প্রশাসন যথেষ্ট সতর্কই ছিল। নিয়ম ভেঙে উল্টো পথে ঢুকেই বিপদ ডেকে এনেছেন তীর্থযাত্রীরা। সৌদি রাজকুমার মহম্মদ বিন নায়েফও আশ্বস্ত করেছেন, ‘‘তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’’
হেল্পলাইন নম্বর: ০০৯৬৬১২৫৪৫৮০০০/ ০০৯৬৬১২৫৪৯৬০০০
টোল-ফ্রি নম্বর ৮০০২৪৭৭৭৮৬
এই সংক্রান্ত আরও খবর:
পড়ুন: এ রাজ্যের হজযাত্রীরা সুস্থই আছেন, আশা কমিটির
পড়ুন: ঘণ্টাখানেক পরেই রাস্তা কিন্তু স্বাভাবিক