ভাষণরত।
ক্ষমতা বড় বালাই। তাই জনগণেশকে তুষ্ট করতে নেতাদের কি-ই না করতে হয়। জঙ্গলরাজের নায়ক লালুর জন্মদিনে ফুল নিয়ে হাজির হন নীতিশ কুমার। ভাবধারায় সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও কাশ্মীরের মসনদে হাত ধরাধরি করে বসে বিজেপি-পিডিপি। কংগ্রেসকে হঠাতে ময়দানের জনসভায় জ্যোতি বসু হাত ধরেন অটলবিহারী বাজপেয়ীও। দেশে দেশে, কালে কালে এমন উদাহরণ বিরল নয়। তাই মার্কিনমুলুকে ২০১৬-এর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডেমোক্র্যাট দলের সদস্য হিলারি ক্লিন্টন যখন বক্তৃতায় তাঁর মায়ের কথা তোলার কথা ভাবেন তখন বিস্ময় না জাগলেও অনুসন্ধিৎসা তো হয়ই। দুঁদে আইনজীবী, প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি, নিউ ইয়র্কের সেনেটর, ওবামা প্রশাসনের এক সময়ের বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টনের নামের পাশে তারকা চিহ্ন কম নেয়। তবে অত্যন্ত ব্যক্তিগত মানুষ বলে মার্কিন রাজনৈতিক মহলে তাঁর খ্যাতি আছে। তা হলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে তিনি কেন টেনে আনবেন মায়ের কথা? আর কেনই বা তাঁর মায়ের জীবন তাঁকে জনগণের প্রত্যাশিত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করে তুলবে?
যে ভাবে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসারী ওবামা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রামের মুখ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, হিলারির পক্ষে তা কি সম্ভব? ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সম্পদে মার্কিন দেশের প্রথম এক শতাংশ নাগরিকদের মধ্যে পড়ে ক্লিন্টন পরিবার। ফলে ‘আমি তোদেরই লোক’ প্রমাণ করা হিলারির পক্ষে বড় কঠিন কাজ। এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে কিছু বিতর্ক। প্রশ্ন উঠেছে স্বামী বিল ক্লিন্টনের বিপুল তহবিল সম্পর্কে। প্রশ্ন উঠেছে গাঁধী পরিবারের জামাই রবার্ট বঢ়রার মতোই মেয়ে চেলসি-র স্বামীও কি শ্বশুর, শাশুড়ীর প্রভাব খাটিয়ে তাঁর ব্যবসা বাড়াচ্ছেন? সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদেশ সচিব থাকার সময়ে ব্যক্তিগত ইমেল ব্যবহার নিয়েও। প্রশ্ন উঠেছে লিবিয়ার বেনগাজিতে জঙ্গি হামলায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মৃত্যুর সময়ে তাঁর পরিস্থিতি সামলানোর দক্ষতা নিয়েও। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে সাধারণ মার্কিনিদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা কমেছে। হিলারির নির্বাচনী টিম তাতে বিশেষ শঙ্কিত না হলেও, সিঁদুরে যে মেঘ জমছে তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই হিলারি এ বার কথা বলবেন চার বছর আগে প্রয়াত তাঁর মা ডরোথিকে নিয়ে। কারণ, সাধারণের জীবনসংগ্রাম তাঁর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। বলবেন তাঁর পরিবারও আমজনতার মতোই। আদায় করার চেষ্টা করবেন মধ্যবিত্ত মার্কিনিদের সহানুভূতি। শনিবার একটি নিরাবচনী জনসভাও রয়েছে তাঁর।
তিন প্রজন্ম: মা ডরোথি এবং কন্যা চেলসিকে সঙ্গে নিয়ে হিলারি।
ডরোথি-র জীবন প্রায় হিলারি-র বিপরীত মেরুতে। আট বছর বয়সেই মা-বাবার কাছ ছাড়া ডরোথি আর তাঁর বোন। নিত্য-ঝগড়া, মারপিট, পরে অবশেষে ভেঙে যায় তাঁদের মা-বাবার বিয়ে। শিকাগোর বোর্ডিং থেকে দুই বোন চলে গেলে ক্যালিফোর্নিয়ায় ঠাকুর্দার কাছে। সেই জীবনও মোটেই সুখকর হয়নি ডরোথির। পান থেকে চুন খসলেই অত্যন্ত কড়া ঠাকুর্দাদা, ঠাকুমা শাস্তি দিতেন। এক বার তো প্রায় এক বছর কার্যত গৃহবন্দি ছিলেন ডরোথি। শুধু স্কুলে যাওয়া ছাড়া ঘরের বাইরে বেরনোর অনুমতি ছিল না। সঙ্গে ছিল দারিদ্র। দুধও জুটতো না তাঁর। স্কুলের এক সহৃদয় শিক্ষক তাই দুধ কিনে ডরোথিকে খাওয়াতেন। সেই শিক্ষকই ১৪ বছরের ডরোথিকে বাড়ি দেখাশোনার একটা কাজ জুটিয়ে দেন। সাপ্তাহিক বেতন তিন ডলার। সেই ভরসাতেই বাড়ি ছাড়েন ডরোথি। সেই শিক্ষকের উৎসাহেই স্কুলের পড়াশোনা শেষ হয় তাঁর।
কিন্তু কলেজে যাওয়ার স্বপ্ন সফল হয়নি ডরোথির। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তাঁকে ডেকে পাঠান তাঁর মা। তবে কলেজে ভর্তির জন্য নয়, বাড়ির নিত্যদিনের কাজ সামলানোরে জন্যেই। শেষে কেরানির কাজ জোটে ডরোথি-র।
১৯৮৭, হিলারির তখন ব্যস্ত আইনজীবী। দরদি মায়ের মতো স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে ছোট্ট চেলসিকে সামলাতে হিলারির সঙ্গে থাকতে শুরু করেন ডরোথি। ১৯৯৩-এ স্বামীর মৃত্যুর পরে ডরোথি আরও জড়িয়ে পড়েন হিলারির সংসারে। সেই সংসার তখন উঠে গিয়েছে মার্কিন ক্ষমতার কেন্দ্র হোয়াইট হাউজে। ফার্স্ট লেডি হিলারি আর ছোট্ট চেলসিকে নিয়ে ভারত, চিন, ফ্রান্স, হাওয়াই— ঘুরে বেরিয়েছেন। কিন্তু প্রচারের আলো থেকে দূরে থেকেছেন। জীবন কাটিয়েছেন সাধারণের মতো। শুধু ১৯৯৬-এ বিল ক্লিন্টনের পুনর্নির্বাচনের সময়ে একটি প্রচার ভিডিওয় জামাইকে সমর্থনের কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন তিনি। তবে মোনিকা লিউয়েনস্কি কেলেঙ্কারির সময়ে সেই সম্পর্কে চিড় ধরে বলে মার্কিন মহলে কানাঘুঁষো শোনা যায়।
২০০৮: সপরিবারে হিলারি।
এই ডরোথির অনুপ্রেরণাতেই হিলারির রাজনীতিতে আসা। নিউ ইয়র্ক থেকে সেনেটের নির্বাচনে দাঁড়ানো। বাকিটা ইতিহাস। মৃত্যু পর্যন্ত মা-মেয়ের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বিদেশ সচিবের দায়িত্বের বিপুল ধকল সামলেও প্রতি দিন সন্ধ্যায় মা-মেয়ে গল্পে মশগুল হতেন। আম জনতার মতো মা-মেয়ের সেই জমাটি আড্ডায় রাজনীতি থেকে টেলিভিশনের জনপ্রিয় ধারাবাহিক— কিছুই বাদ থাকত না। সেই সুখস্মৃতি রেখে চার বছর আগে চলে গিয়েছেন ডরোথি। এ বার সেই সব অজানা কথাই আম জনতাকে শোনাবেন হিলারি। সেই জন্য শুধু নামজাদা বক্তৃতা লিখিয়েই নয়, কলম ধরেছেন হিলারি স্বয়ং। নির্বাচনী প্রচারের ব্যস্ততার মধ্যেও মধ্যবিত্ত জনতার মন জেতার আশায় কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশ কিছু সময়ে এর পিছনে ব্যয় করেছেন তিনি। ডরোথির পাশাপাশি সেই শিক্ষকের মতো অনেকের কথাই তুলে ধরবেন হিলারি সাধারণ, মার্কিন পারিবারিক জীবনকে ছোঁয়ার আকুল আবেদন নিয়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সব কিছুর শেষে হোয়াইট হাউজে একটি আদর্শ পরিবারকেই দেখতে চায় মার্কিন আমজনতা। হিলারি আজ নিজেও ঠাকুমা। চেলসির ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে বিল-হিলারির ছবি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ বার সেই ছবির পাশেই যেন নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছেন ডরোথি, একটি আদর্শ পরিবারকে সম্পূর্ণ করার জন্য।
হিলারির পক্ষে এই সিদ্ধান্ত অবশ্য অনেকটাই তাঁর চরিত্রের বিপরীত। ১৯৯২-এ বিল ক্লিন্টনের প্রথম প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ের সময়ে চেলসিকে নিয়ে তাঁদের পরিবারের একটি ভিডিও তৈরির পরিকল্পনা হিলারির আপত্তিতেই ভেস্তে যায়। ২০০৮-এর প্রাইমারি নির্বাচনে আইওয়া প্রদেশের কয়েকটি জায়গায় ডরোথির কথা প্রচারে ব্যবহার করেছিল হিলারি-র নির্বাচনী টিম। সদর্থক ফিডব্যাকও পেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু রাজি হননি হিলারি। মাকে নিয়ে আর কথা বলতে চাননি তিনি। এ বার সেই কুণ্ঠা ভাঙলেন তিনি। মা’র দারিদ্রপীড়িত শৈশবের কাহিনী শুনলে আম জনতার যদি মন গলে, কুণ্ঠা ভাঙতে আপত্তি কোথায়?
ছবি: এএফপি এবং গেটি ইমেজেস।