নিকোলাস মাদুরো। ছবি: এপি।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তারই মাথার উপর দিয়ে বনবন করে পাখা ঘুরিয়ে উড়ছে সেনা হেলিকপ্টার। পর পর চারটে গ্রেনেড ছোড়া হল সেই হেলিকপ্টার থেকে। কিছু ক্ষণের মধ্যে সেই কপ্টারের দেখা মিলল পার্লামেন্ট ভবনের উপরে। এ বার অভ্যন্তরীণ মন্ত্রক লক্ষ করে চলল গুলি। টানা ১৫ বার। হলিউডের ছবি নয়। মঙ্গলবার এমন দৃশ্যের সাক্ষী থাকল ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাস।
প্রেসি়ডেন্ট নিকোলাস মাদুরো কালকের এই জোড়া হামলাকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দিয়েছেন। যদিও হতাহতের কোনও খবর নেই। প্রেসিডেন্টের দাবি, তাঁর সরকারকে ফেলার জন্য জঙ্গিপনার মাধ্যমে সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা চলেছিল। সেই সঙ্গেই তাঁর হুঁশিয়ারি, সরকারের বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপও বরদাস্ত করা হবে না। সেনা কপ্টার চুরি করে হামলা চালানো হয়েছে বলেও দাবি করেছেন প্রেসিডেন্ট। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কোর্ট চত্বরে সেই সময় একটি অনুষ্ঠান চলছিল। অনেক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। কারও কিছু হলে কী হতো! খুব শীঘ্রই ওই কপ্টারটির সন্ধান চালিয়ে তার পাইলটকে হেফাজতে নেওয়া হবে।’’ প্রেসিডেন্টের নির্দেশে কারাকাসের রাস্তায় নামানো হয়েছে সেনা। বিক্ষোভ রুখতে ছুটছে কাঁদানে গ্যাসও।
গোলমালের সূত্রপাত অবশ্য মাস তিনেক আগে। তেল সমৃদ্ধ দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলা শুরু হয়েছে গত এপ্রিল থেকেই। মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক মন্দা, ওষুধের জন্য হাহাকার—এটাই এখন ভেনেজুয়েলার দৈনন্দিন ছবি। এক সময়ের আর্থিক সমৃদ্ধি এখন তলানিতে ঠেকেছে। আর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট উগো চাভেসের জায়গায় বসা মাদুরোর বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমেছে। মাদুরোকে সরাতে রাস্তায় নেমেছেন সাধারণ মানুষ। সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ দমনে সেনার হাতে এই তিন মাসেই প্রাণ গিয়েছে ৭৫ জনের। গত সপ্তাহেও বাইশ বছরের এক তরুণকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মেরেছে সেনা। সেই বিতর্ক এখনও টাটকা।
মাদুরোর বিরুদ্ধে ক্ষোভের সবচেয়ে বড় কারণ হলো আগামী ৩০শে জুলাইয়ের ভোট। মুখে শান্তি ফেরানোর জন্য ওই ভোট করানো হচ্ছে বললেও বিরোধীদের বক্তব্য, মাদুরোর আসল উদ্দেশ্য অন্য। সংবিধান সভার মাধ্যমে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট, যাতে বিরোধীদের দখলে থাকা কংগ্রেসের ক্ষমতা খর্ব করা হবে। তাই যে কোনও অবস্থায় ওই ভোট করাতে বদ্ধপরিকর মাদুরো। এই অবস্থায় দেশের সুপ্রিম কোর্টও বর্তমান প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাশালী করে তুলতে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের। কাল সে জন্যই সুপ্রিম কোর্টকে নিশানা করা হয়েছে বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন অনেকে। মাদুরো অবশ্য সব কিছুর পিছনে আমেরিকার হাত দেখছেন। তেলের উপরে কব্জা করার জন্য হোয়াইট হাউসই তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ইন্ধন দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় কালকের হামলার যে যে ছবি পোস্ট হয়েছে, তার থেকে উঠে এসেছে একটি মাত্র নাম। অস্কার পেরেজ। মধ্য তিরিশের এই পাইলটই কাল সেনা কপ্টার নিয়ে ঘণ্টা দু’য়েক ধরে কারাকাসের আকাশে তাণ্ডব চালিয়েছেন। ভেনেজুয়েলার পুলিশ বিভাগের বিশেষ তদন্তকারী এই অফিসার অভিযানের একটি ভিডিও বার্তাও পোস্ট করেছেন অনলাইনে। সেই ভিডিওয় দেখা গিয়েছে, কালো মুখোশে মুখ ঢাকা জনা চারেক সশস্ত্র ব্যক্তির সামনে সেনা পোশাকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অস্কার। ক্যামেরার চোখে চোখ রেখে তিনি বলেছেন, ‘‘কোনও রাজনৈতিক দলের লোক নই আমরা। দেশের পুলিশ, সেনা আর সাধারণ মানুষ মিলেই অপরাধীদের সরকারকে সরাতে চাই। আমরা জাতীয়তাবাদী, আমরা দেশপ্রেমী।’’
মাদুরো অবশ্য অস্কারের পিছনে রাজনৈতিক ইন্ধনের অভিযোগ এনেছেন। দেশের প্রাক্তন বিচার ও অভ্যন্তরীণমন্ত্রী রডরিগুয়েজ টরেসই অস্কারকে সামনে রেখে কলকাঠি নাড়ছেন বলে অভিযোগ প্রেসিডেন্টের। এক সময় টরেসের হয়ে কাজ করতেন অস্কার। টরেস অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। কাল অস্কার যখন কপ্টার নিয়ে অভিযান চালাচ্ছেন, দু’ঘণ্টাতেও কেন তাঁকে ধরা গেল না, সে প্রশ্ন অবশ্য উঠছে।